১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু। ৩৮ বছর অতিবাহিত হলেও বিকেএসপি কাঙ্ক্ষিত ‘এক্সিলেন্স ইন স্পোর্টস’ হয়ে উঠতে পারেনি। বিকেএসপির ‘ক্রীড়ায় শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জন করতে না পারার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া প্রতিবেদক আরাফাত জোবায়ের।

ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে তুলে ধরা হয়েছিল কোচদের ও কোচিংয়ের সংকটের চিত্র। দ্বিতীয় পর্বে উঠে এসেছিল দুই যুগ পার করা ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের বেহাল পরিস্থিতি এবং ক্রীড়াঙ্গনে এর প্রভাব। তৃতীয় পর্ব ছিল বিকেএসপি শিক্ষার্থীদের অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা এবং জাতীয় পর্যায়ে সেরা হয়েও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেভাবে সাফল্য না পাওয়ার নেপথ্য কারণ নিয়ে। চতুর্থ পর্বে বিকেএসপির অবকাঠামো ও আঞ্চলিক কেন্দ্রের সমস্যাদি তুলে ধরা হয়। আজ পঞ্চম ও শেষ পর্বে বিকেএসপি শিক্ষার্থীদের ক্রীড়াঙ্গনে সম্পৃক্ত না হতে পারার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

স্নাতক, ডিগ্রি চালু করেও মিলছে না সুফল

বিকেএসপি খেলার প্রতিষ্ঠান হলেও এখানে একাডেমিক কার্যক্রম অনুযায়ী ভর্তি ও বিদায় ঘটে। একজন শিক্ষার্থী কলেজের পরই মূলত প্রাণপ্রিয় বিকেএসপি ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হয়। ইন্টারমিডিয়েটের পর অনেক শিক্ষার্থী হারিয়ে যান ক্রীড়াঙ্গনের মূল স্রোতে টিকতে না পেরে। এজন্য বিকেএসপি কর্তৃপক্ষ আরো কয়েক বছর আগে ডিগ্রি এবং সম্প্রতি অনার্স কোর্স চালু করেছে। যেন বিকেএসপি শিক্ষার্থীরা সেখানে ভর্তি হয়ে আবাসন ও অনুশীলনের সুবিধা পেয়ে নিজেদের আরো প্রস্তুত করতে পারে। এটা করেও তেমন সুফল মিলছে না।

বিকেএসপির একাধিক কোচ এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেকে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বা একই মানের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। কেউ মেধা আবার কেউ খেলোয়াড় কোটার মাধ্যমে ভর্তি হচ্ছে। ফলে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে কেউ আর বিকেএসপিতে থাকতে চাইছে না। এজন্য স্নাতক ও ডিগ্রি পর্যায়ে বিকেএসপিতে পড়তে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হয় না।’

স্নাতক ও ডিগ্রি কোর্সে বিকেএসপি থেকে বেড়ে উঠা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকলেও বাইরে থেকে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কিন্তু বেশি। যারা বিকেএসপিতে আলাদা হোস্টেল, ডাইনিং, সুবিধা ব্যবহার করেন। নির্দিষ্ট সময়ের পর একটি ডিগ্রি নিয়ে বের হন কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা।

ফেডারেশন-বিকেএসপি সমন্বয়হীনতা

ক্রীড়াবিদরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ফেডারেশনের মাধ্যমেই। বিকেএসপির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ সেই অর্থে নেই। বিকেএসপির তৈরিকৃত খেলোয়াড়ই ফেডারেশনের পাইপলাইন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ ফেডারেশন ও বিকেএসপির মধ্যে থাকে দূরত্ব। যার ফলে বিকেএসপির খেলোয়াড়রা এক পর্যায়ে গিয়ে হারিয়ে যান। বিকেএসপির সাবেক মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুনীরুল ইসলাম মাস ছয়েক আগে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিকেএসপি ও ফেডারেশনগুলোর সঙ্গে মত বিনিময় করেছিলেন। যেটা ছিল সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে প্রথম উদ্যোগ।

ক্রিকেট, ফুটবলে ১৫০০ জনে ১০০ জন জাতীয় দলে

দেশের দুই শীর্ষ খেলা ফুটবল ও ক্রিকেট। তিন যুগে বিকেএসপিতে ৬ বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এমন সংখ্যা ক্রিকেটে ৮৪৫ আর ফুটবলে ৭০৫। অথচ সেখান থেকে সিনিয়র জাতীয় দলে ক্রিকেটে ৫৬ আর ফুটবলে সংখ্যা ৫০ জন। দশ শতাংশেরও কম। সিনিয়র দলে শতকার হার দশের কাছাকাছি হলেও যুব দলে অবশ্য বেশি। ক্রিকেটে ৩৬০ জনের বিপরীতে ফুটবলে ৩৫২ জন। ফলে যুব দল থেকে মাত্র দশ শতাংশের বেশি নিজেদের সিনিয়র দলে নিতে পারেন।

মাদার অব অল ডিসিপ্লিন হিসেবে খ্যাত অ্যাথলেটিক্স। বিকেএসপিতে ৬ বছর প্রশিক্ষণ নেয়া অ্যাথলেটিক্স শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩৯ জন। অ্যাথলেটিক্স জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা মাত্র ৪৬ জন। অন্যান্য খেলাতেও হার এই রকম। তবে নতুন শুরু করা ডিসিপ্লিন আরচ্যারিতে অবশ্য চিত্র খানিকটা ভিন্ন। ৫০ জনের মধ্যে ৩৬ জনই জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

প্রিমিয়ার লিগও খেলতে পারেন না অনেকে

বিকেএসপিতে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবিদ হবেন এমনটাই ব্রত। আন্তর্জাতিক মানের তো দূরের কথা, অনেক শিক্ষার্থী প্রিমিয়ার লিগও খেলতে পারেন না। ছয়-সাত বছর অনুশীলন করার পরও একজন খেলোয়াড় প্রিমিয়ার লিগেও স্থায়ীভাবে খেলতে পারেন না। দেশের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগের পর একজন শিক্ষার্থী ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্য কোনো খেলায় ঘরোয়া লিগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে না খেলতে পারা বেশ প্রশ্নবিদ্ধই। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান এমিলি বলেন, ‘এই বিষয়টি অবশ্যই বড় ধরনের ভাবনা ও গবেষণাযোগ্য। ১৭-১৯ বছর বয়সে একজন ছেলে/মেয়ে বিকেএসপিতে থেকে বের হন। প্রিমিয়ার পর্যায়ে আসতে অনেক সময় আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়। সেই সময় পর্যন্ত অবশ্য অনেক শিক্ষার্থী নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেন না আবার অনেক সময় প্রয়োজনীয় সহায়তাও পায় না। ’

বিকেএসপির শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

বিকেএসপি খেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাতীয়-আন্তর্জাতিক কিংবা ঘরোয়া পর্যায়ে খেলবেন এটাই হওয়ার কথা। বিকেএসপির অনেক শিক্ষার্থী পরবর্তীতে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন। বিকেএসপির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হকির টুটুল কুমার নাগ। সাবেক এই হকি খেলোয়াড় বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার। বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনিই প্রথম সিভিল সার্ভিস ক্যাডার।

বিকেএসপিতে খেলা ও শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও পড়াশোনায় অগ্রসরতা নিয়ে টুটুল কুমার নাগ বলেন, ‘বিকেএসপির অনুশীলন ও খেলার বাইরে আমি নিয়মিত পড়াশোনা করেছি। বিকেএসপির ক্লাসে সব সময় আমি ফাস্ট হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে পড়াশোনা করেছি। এরপর পরিশ্রম করে বিসিএস ক্যাডার হয়েছি।’

বিকেএসপির আরেক সাবেক শিক্ষার্থী সৌরভ গত পরশু দিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে অধ্যাপক হয়েছেন। তিনি ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। এ  রকম আরো অনেকে বিকেএসপি থেকে অন্য পেশাগত ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এই বিষয়ে টুটুল বলেন, ‘বিকেএসপিতে সবচেয়ে বড় বিষয় শৃঙ্খলা। সেই শৃঙ্খলা জীবনে অন্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেও আমরা ভালো করতে পারি।’

মন্ত্রণালয়ের নেই পর্যাপ্ত তদারকি

বিকেএসপি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান। বিকেএসপি খেলাধূলার আতুড়ঘর। এখানে হাজার খানেকের উপর শিক্ষার্থী থাকলেও বিভিন্ন খেলায় জাতীয় দলে অংশগ্রহণ বা প্রতিনিধিত্বকারীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক বা কখনো অর্ধেকের একটু বেশি। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবিদের সংখ্যা আরো কম। বিকেএসপির মান উন্নয়ন ও আরো উৎকর্ষতা সাধনের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে তাগাদা কিংবা সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতা কিংবা লক্ষ্যপূরণ নেই। গতানুগতিক বাৎসরিক রিপোর্ট কিংবা চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ।

এজেড/এইচজেএস