ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসহ দেশ ও জাতির অনেক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের শুধু শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেই নয়, ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে অসামান্য অবদান। জন্মের পর থেকেই খেলাধুলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষভাবে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আজ (শুক্রবার) দ্বিতীয় পর্বে ট্রফির আদ্যোপান্ত তুলে আনার চেষ্টা করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।

 

১৯২১ সালে জন্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র অফিসের সূচনা ১৯২৫ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টির পর থেকেই খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ শুরু হয়। ব্লু কোন সাল থেকে প্রদান করা হয় এর মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ট্রফিরও কোনা সুনির্দিষ্ট তথ্য ও রেকর্ড পাওয়া যায়নি। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বেশ কয়েকটি ডিসিপ্লিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্ব আছে। স্বাধীনতার বহু আগেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনমালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল নানা অর্জন। সেই সব অর্জনের স্মৃতি বা স্মারক হচ্ছে ট্রফি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শারীরিক শিক্ষা অফিসে দু’দিন ঘুরেও পাকিস্তান ও ব্রিটিশ শাসনামলের খুব বেশি ট্রফি পাওয়া যায়নি। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শাহজাহান আলী প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তার জন্য ও ইতিহাস সংরক্ষণের তাগিদে স্টোর রুম খুলে ট্রফির সন্ধান করেন। স্টোর রুম থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েরই বেশি ট্রফি পাওয়া গেছে। 

সেখানে একটি শিল্ড পাওয়া গেছে ১৯৩১ সাল লেখা। কোন খেলার, চ্যাম্পিয়ন না রানারআপ সেটা বোঝার সুযোগ নেই। এ রকম আরো কয়েকটি শিল্ড ও ট্রফি দেখা গেল অস্পষ্ট। ধুলোর আস্তরণে পড়ে থাকতে থাকতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও স্মারকের এই পরিস্থিতি।

ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হলেও শাহজাহান আলী এখন এই ট্রফির ব্যাপারে খুবই উদ্যোগী হয়েছেন, ‘ট্রফি যত্ন সহকারে রাখা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক পুরনো ও অস্পষ্টগুলো বিশেষভাবে ধোয়া মোছা করে কোন সাল, কোন টুর্নামেন্ট সেটা পুনরুদ্ধার করে লিপিবদ্ধ করব।’ বলছিলেন তিনি। মূলত এই প্রতিবেদকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এমন উদ্যোগের সৃষ্টি। শওকতুর রহমান চিনুসহ বিগত পরিচালকরা পদে থাকলেও এই ট্রফি সংরক্ষণ ও সাফল্যের কোনো তালিকা করেননি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও দেশের সবচেয়ে প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রফি অর্জন ও সংরক্ষণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছাত্র অবস্থায় ও পরবর্তীতে পেশাগত কারণে ব্রিটিশ আমলের অর্জনের ট্রফি খুঁজেছি, পাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ আমলে নানা খেলা আয়োজন করত ও সাফল্যও ছিল। কিন্তু সেগুলো সংরক্ষিত নেই।’ 

পাকিস্তান আমলে গভর্নস কাপ ও এএফ রহমান শিল্ড আয়োজন করত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই শিল্ড ও কাপের কোনো ছবি ও ট্রফি পাওয়া যায়নি। ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি কম্বাইন্ড টিমের ফুটবলে অধিনায়কত্ব করেছেন আবদুস সাদেক। পশ্চিম পাকিস্তান সফরও করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলার জন্য। 

সেই সফরের ছবি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা উচিত বলে মনে করেন কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ আবদুস সাদেক, ‘আন্ত বিশ্ববিদ্যালয় খেলা ভালো খেলোয়াড়দের নিয়ে ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি কম্বাইন্ড টিম হতো। সেই দলের অধিকাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই থাকত। আর কয়েকজন রাজশাহী ও অন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের। পশ্চিম পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খেলছে এ রকম স্মৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থাকা উচিত।’

পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে শিরোপা না পেলেও পাকিস্তান আমলেও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় হকি ও ফুটবলে একাধিক ট্রফি আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। 

স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটির ফুটবলে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতো। আশির দশকে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শফিকুল ইসলাম মানিকের অধিনায়কত্বে। সেই শিরোপা প্রসঙ্গে মানিক বলেন, ‘আগে ফাইনাল খেললেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। আমার অধিনায়কত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেনাবাহিনীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। এটা আমার স্মরণীয় একটি মুহূর্ত।’

সেই ট্রফিসহ ক্রিকেট, হকি, ভলিবল, বাস্কেটবলসহ অনেক খেলার আরও অনেক ঐতিহাসিক অর্জন খুজতে গলদঘর্ম হতে হয়। ডিসিপ্লিন বা অর্জনের গুরুত্ব অনুসারে সাজানো নেই কিছু। সবই এলেমেলোভাবে। আন্তঃবিভাগ ও হলের ট্রফিগুলো স্ব স্ব হল ও বিভাগের। শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে মূলত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনের অর্জনের স্মারকগুলো। 

পরিচালকের কক্ষে তিনটি শোকেসে, স্টোর রুম ও অফিসের নিচ তলায় সব মিলিয়ে কয়েক শ ট্রফি ও শিল্ড। ২০০৫-০৬ সালের দিকে শারীরিক শিক্ষা বিভাগ তাদের ট্রফি, শিল্ড নিয়ে একটি প্রদর্শনীও করেছিল অবশ্য। তবে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পিরিয়ডে ট্রফি ও শিল্ডের স্বল্পতা ছিল। 

এজেড/এমএইচ