ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসহ দেশ ও জাতির অনেক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের শুধু শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে নয়, ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে অসামান্য অবদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ক্রীড়া বিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্বে ক্রীড়াক্ষেত্রে ডাকসুর ভূমিকা নিয়ে সাবেক ক্রীড়া সম্পাদকদের বক্তব্য তুলে এনেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। এক বছর পরেই সৃষ্টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের। পরবর্তীতে এটির নামকরণ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। ১৯৫৩ সালে শিক্ষার্থীদের ভোটে প্রথম নির্বাচিত ডাকসুর কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ডাকসু ভিপি, জিএসের পরেই সবচেয়ে আলোচিত পদ ছিল ক্রীড়া সম্পাদক। স্বাধীনতার আগে ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক পদ ছিল কি না এই ব্যাপারটি ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ক্রীড়াবিদরা মনে করতে পারেননি।

কিংবদন্তিতুল্য ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব আবদুস সাদেক ষাটের দশকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে ক্রীড়া সম্পাদক পদ ছিল কি না মনে পড়ছে না, তবে হলগুলোতে অ্যাথলেটিকস সম্পাদক পদ ছিল।’ সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সাদেক নিজেই অ্যাথলেটিকস সম্পাদক ছিলেন, ‘রাজনীতি, নির্বাচন আমাকে তেমন টানত না। ঢাকার বাইরে হকি খেলতে গেছি, বিশ্ববিদ্যালয় এসে শুনি আমার হয়ে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু আমার জন্য হলের অ্যাথলেটিকস সম্পাদক ফরম নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমি নির্বাচিত হই এবং দায়িত্ব পালন করি।’

আবদুস সাদেকের সাথে একমত পোষণ করে প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষার্থী মুহাম্মদ কামরুজ্জামান যোগ করেন, ‘সেই সময় হল ছাত্র সংসদ খুব সক্রিয় ছিল। তারা নানা আয়োজন করত। পাশাপাশি শারীরিক শিক্ষা অফিস থেকে মতিউর রহমান সাহেব (সাবেক ক্রিকেটার ইউসুফ রহমান ও সামিউর রহমানের বাবা) কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আউটডোর গেমস আয়োজন করতেন। খেলার মাঠ সব সময় ব্যস্ত থাকত।’

স্বাধীনতার পর ডাকসু নির্বাচনে অন্যতম আকর্ষণ ছিল ক্রীড়া সম্পাদক পদ। স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচিত ক্রীড়া সম্পাদক হন ওয়াহিদুজ্জামান পিন্টু। বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে ডাকসুর প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি, ‘আমার সময় সুইমিংপুলসহ আরও আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলার চর্চা হওয়া- এটা তরুণ সমাজের মধ্যে সেই সময় বিকশিত হয়েছে।’

‘বাদল ভাই ও পিন্টু ভাই উভয়কে আমি ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে পেয়েছি। তারা আমরা যারা খেলোয়াড় ছিলাম তাদের তো বটেই সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও খোঁজ খবর নিতেন। আমরা খেলার সুযোগ সুবিধা ঠিক মতো পাচ্ছি কি না খোঁজ রাখতেন।’

ডাকসুর দ্বিতীয় ক্রীড়া সম্পাদক নন্দিত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব বাদল রায় পৃথিবী ছেড়েছেন মাস সাতেক আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়াঙ্গনে তারও অবদান ছিল অনেক। বাদল রায়কে ডাকসু সম্পাদক হিসেবে পেয়েছিলেন তারকা ক্রিকেটার গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ক্রীড়াক্ষেত্রে ডাকসুর ভূমিকা দেখছেন এভাবে- ‘বাদল ভাই ও পিন্টু ভাই উভয়কে আমি ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে পেয়েছি। তারা আমরা যারা খেলোয়াড় ছিলাম তাদের তো বটেই সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও খোঁজ-খবর নিতেন। আমরা খেলার সুযোগ সুবিধা ঠিক মতো পাচ্ছি কি না খোঁজ রাখতেন।’

পরবর্তী দুই ক্রীড়া সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মানিক ও ছাইদ হাসান কানন সম্পর্কে লিপুর মতোই বক্তব্য তার অনুজ সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার সেলিম শাহেদের। তিনি বলেন, ‘ডাকসু থাকলে খেলোয়াড়দের ও শিক্ষার্থীদের একটা জায়গা থাকে। আমাদের অভাব, অভিযোগ ও পরামর্শগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে সেভাবে বলা যেত না। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে ক্রীড়া সম্পাদকের কাছে বলতাম, তারা আমাদের হয়ে কাজ করতেন।’

নব্বই দশক পর্যন্ত চার ক্রীড়া সম্পাদকের চারজনই ফুটবলার এবং সবাই মোহামেডানের। সর্বশেষ ১৯৯০ নির্বাচনে কানন হারিয়েছেন মানিক, ইমতিয়াজ সুলতান জনি ও কায়সার হামিদকে। তখন তারা চারজনই মোহামেডানের এবং সবাই রুমমেট। আবাহনীর সেই সময়ের অধিনায়ক ও তারকা ক্রিকেটার ডাকসু নির্বাচনে ক্রিকেটারদের ও আবাহনীর কারও অংশগ্রহণ না করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ক্রিকেটাররা (জিএস হাসান তামিম, তারিকুজ্জামান মুনির, জালাল ইউনুস, গোলাম নওশের প্রিন্সসহ আরও অনেকে) লেখাপড়া ও খেলা দুটো নিয়ে অনেক ব্যস্ত ছিলাম।  ডাকসুর দিকে তেমন আগ্রহী ছিলাম না। নির্বাচনটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, এখানে ক্লাবের তেমন কিছু নেই। আবাহনী ক্লাবও হয়তো সেই সময় সেভাবেই দেখেছে। আশি-নব্বই দশকে ফুটবলারদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। ওই সময় অন্য ডিসিপ্লিনের কারও নির্বাচনে প্রার্থী হলে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়তে হতো।’

৭৩ এর অধ্যাদেশে ডাকসুর মেয়াদ এক বছর। ১৯৭৯-৮১ পর্যন্ত এক বছর পরপর নির্বাচন হলেও পরবর্তী নির্বাচন হয়েছে সাত বছর পর। শফিকুল ইসলাম মানিক ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৮৮-৮৯ সালে। তিনি নির্বাচিত হয়ে খেলার মাঠের পরিবেশ উন্নয়ন, অনাবাসিক ছাত্রদের জন্য আলাদা ফুটবল টুর্নামেন্ট করেন। 

ডাকসু থাকলে খেলাধুলার দাবি দাওয়া নিয়ে আলাপ আলোচনা করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে ক্রীড়া-সংস্কৃতিতে রূপ দিতে সহায়ক হয়।

বিভিন্ন রুটে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের নামে সেই টুর্নামেন্ট অব্যাহত রেখেছিলেন কাননও। এই দুই সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক ডাকসুকে খেলার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, ‘ডাকসু থাকলে খেলাধুলার দাবি দাওয়া নিয়ে আলাপ আলোচনা করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে ক্রীড়া সংস্কৃতিতে রূপ দিতে সহায়ক হয়।’ 

খেলোয়াড় কোটায় যোগ্য খেলোয়াড়দের ভর্তির ক্ষেত্রে ডাকসুকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছেন কানন, ‘আমি যখন ডাকসু ক্রীড়া সম্পাদক ছিলাম, তখন সকল যোগ্য খেলোয়াড়দের ভর্তি করেছি। মানিক ভাই ও আমার পূর্বসূরিরা তাই করেছে। ভর্তিতে কোনে অনিয়ম হয়নি। জাতিও শিক্ষিত এক ক্রীড়া সমাজ পেয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট সবার ধারণা, ডাকসু থাকলে খেলোয়াড় কোটায় অনিয়ম ও খেলোয়াড় কোটা এক দশক বন্ধও থাকত না।

অনেক আলোচনার পর ২০১৪-১৫ সেশন থেকে শুধু বিকেএসপি কোটায় খেলোয়াড়রা ভর্তি হতে পারছেন। এই পদ্ধতিরও সংস্কার চেয়েছিলেন ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচনে ক্রীড়া সম্পাদক হওয়া তানভীর। এই পদে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগে আমাদের কার্যক্রম সীমিত হয়েছে। এর মধ্যেও ১৯টি কর্মসূচি করেছি। ইচ্ছে ছিল প্রথমবারের মতো আন্তঃহল ক্রিকেট করার। করোনার জন্য শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হলো না।’

আগের ক্রীড়া সম্পাদকরা শারীরিক শিক্ষা অফিসে একটি কক্ষ ব্যবহার করতেন। ২৮ বছর পর ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক হওয়া তানভীর অবশ্য শারীরিক শিক্ষা অফিসে কক্ষ ব্যবহারের সুযোগ পাননি। শারীরিক শিক্ষা অফিস ও ডাকসুর সম্পর্ক প্রসঙ্গে তানভীর বলেন, ‘শারীরিক শিক্ষা অফিস ডাকসুর খেলা পরিচালনায় সহযোগিতা করে। ক্রীড়া সম্পাদক পদাধিকার বলে সব ক্রীড়া কমিটির সদস্য। দুই তিনটি ডিসিপ্লিনের কমিটির সভা আমাকে ডাকলেও অনেক খেলার কমিটির সভায় আমাকে ডাকা হয়নি।’ 

আশি-নব্বই দশকের পরিস্থিতি ছিল উল্টো। ক্রীড়া সম্পাদকের পরামর্শক্রমেই চলত শারীরিক শিক্ষা অফিস।

এজেড/এটি/এমএইচ