ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসহ দেশ ও জাতির অনেক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের শুধু শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে নয়, ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে অসামান্য অবদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ক্রীড়া বিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্বে ক্রীড়াক্ষেত্রে ডাকসুর ভূমিকা নিয়ে সাবেক ক্রীড়া সম্পাদকদের বক্তব্য তুলে এনেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।।

ব্লু ও ট্রফির মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় কোটার শুরুর সুনির্দিষ্ট সময়কাল জানা যায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই খেলোয়াড় কোটার প্রচলন এটা অবশ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রবীণ সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। 

আজাদ স্পোর্টিংয়ে ফুটবল ও ন্যাশনাল স্পোর্টিংয়ে ক্রিকেট খেলতেন কামরুজ্জামান। এই খেলাধুলাই তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। তার দেওয়া তথ্য মতে, তার ভর্তিরও আগে থেকে খেলোয়াড়রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষভাবে ভর্তির সুযোগ পেতেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক শোষণের প্রতিবাদের মাধ্যম ছিল খেলা। ক্রীড়াবিদদের সুশিক্ষিত করে সমাজ সচেতন করাও ছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি লক্ষ্য। তৎকালীন সময়ে অবশ্য অনেক খেলোয়াড় মেধার পরিচয় দিয়েও ভর্তি হয়েছিলেন। এদের মধ্যে মেজর হাফিজ, আবদুস সাদেক, প্রয়াত এএসএম ফারুক অন্যতম।

স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকেও খেলোয়াড়দের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার আগের মতোই উন্মুক্ত ছিল। আনুষ্ঠানিক কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হতো না তাদের। বিভাগগুলো তাদের পছন্দমতো খেলোয়াড়দের ভর্তি করতো। এভাবে চলে বেশ কয়েক বছর।

পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকতা একটু বাড়ে। খেলোয়াড়দের ভর্তি হতে হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তি পরীক্ষিত অংশগ্রহণ করতে হবে৷ পরীক্ষায় পাশ ফেল কোনো বিষয় না অংশগ্রহণটাই যথেষ্ট। এই প্রক্রিয়ায় অনেক ক্রীড়াবিদ ভর্তি হয়েছেন। এক ক্রীড়াবিদ তার ডাক নামের কাছাকাছি স্কোর করেও ভর্তি হতে পেরেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা হওয়ার বছর ৫০ এর বেশি সময় শুধু খেলাধুলা আয়োজনই ছিল এদের কাজ। খেলোয়াড় ভর্তিতে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। আশি পরবর্তী সময়ে খেলোয়াড় কোটার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পরে এই অফিসের ওপর। খেলোয়াড়েরা আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর এই অফিসের সুপারিশ/প্রত্যায়নের ভিত্তিতে খেলোয়াড়েরা ভর্তি হতেন।

শারীরিক শিক্ষার সুপারিশ করার পরেও মাঝে মধ্যে ওই তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অন্য নাম ঢুকেছে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে খুব সীমিত আকারে এমন অভিযোগ আসা শুরু হয় যোগ্য খেলোয়াড়দের পরিবর্তে তুলনামূলক কম যোগ্যরা ভর্তি হচ্ছেন৷ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনের নাম শারীরিক শিক্ষা অফিসের পাঠানো তালিকায় থাকলেও পরবর্তীতে বাদ পড়ায় তার আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি। যদিও তিনি ততদিনে অধিভুক্ত কলেজের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

ক্রিকেটের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল, হকিতেও সেই সময় অধিভুক্ত কলেজের প্রতিনিধি ছিল অনেক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম তারকা ফুটবলার সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বিরসহ অনেক তারকা ফুটবলার যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পড়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছেন।

ডাকসুর সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক মানিক নিজেই এভাবে খেলেছেন, ‘আমি মাস্টার্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এর আগে অধিভুক্ত কলেজে পড়াবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছি।’ নব্বইয়ের দশকেও স্নাতক অন্য কলেজে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া যেত। মানিকের মতো অনেক ক্রীড়াবিদ স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছিলেন শুধু।

নব্বইয়ের পরবর্তী সময় থেকে খেলোয়াড় কোটায় মাঝেমধ্যে দুই একজন করে স্বজনপ্রীতি, দলীয় চাপের অভিযোগ আসা শুরু হয়। সেটা প্রতিরোধ করতে নিয়মে খানিকটা পরিবর্তন আসে। খেলোয়াড় হলেও ভর্তি পরীক্ষায় অন্তত পাশ করতে হবে। পাশ করার পর শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে হবে। এরপর শারীরিক শিক্ষা অফিস একটি তালিকা পাঠানোর পর ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রীয় কমিটি বিভাগ বণ্টন করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেও ছোটখাটো অভিযোগ ভেসে আসতো।

২০০২-০৩ সেশনের দিকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছাত্র ভর্তি হয় খেলোয়াড় কোটায়। ভর্তিকৃত ছাত্রদের অধিকাংশই অখেলোয়াড়। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রচুর সমালোচনা হয়। এর পরবর্তী সেশন থেকে খেলোয়াড় কোটা একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়। 

শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সাবেক পরিচালক শওকতুর রহমান চিনু সেই সময়ের অনিয়ম নিয়ে বলেন, ‘ওই সময়টায় দলীয় প্রভাবে অনেককে খেলোয়াড় কোটা ভর্তি করানো হয়েছে যারা অখেলোয়াড়। ততকালীন প্রোভিসি স্যারের প্রভাবে এটা হয়েছিল এবং তিনিই পরবর্তীতে খেলোয়াড় কোটা বন্ধ করতে বাধ্য হন।’ 

ডাকসুর সর্বশেষ ক্রীড়া সম্পাদক ছাইদ হাসান কানন অল্প কয়েক বছর শারীরিক শিক্ষা অফিসে কর্মরত ছিলেন। ডাকসু ও পরবর্তী কর্মজীবনে খেলোয়াড় ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, ‘আমি যখন ডাকসু ক্রীড়া সম্পাদক অনেক তারকা ক্রীড়াবিদকে ভর্তি করেছি। যখন চাকরিরত অবস্থায় ছিলাম তখন প্রকৃত ও যোগ্য খেলোয়াড়দেরই ভর্তির জন্য সুপারিশ করেছি। আমার সময় একজনও অখেলোয়াড় ভর্তির সুপারিশ পায়নি।’

২০০৩-০৪ সেশন থেকে খেলোয়াড় কোটা বন্ধ। ওই বছর ভর্তি পরীক্ষা দেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শাহরিয়ার নাফীস। বাণিজ্য অনুষদে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা। খেলোয়াড় কোটা না থাকায় কতটা চাপ নিয়ে মেধাবী শাহরিয়ার পরীক্ষা দিয়েছিলেন এতদিন পরেও তার কণ্ঠে সেটা স্পষ্ট, ‘আমার দাদা ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমার মাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তিনি খুব করে চাইতেন আমি যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে পারি। আমি পরিবারের পরম্পরা রক্ষা করতে পেরে নিজে গর্বিত।’

খেলোয়াড় কোটা বন্ধ থাকার প্রায় এক যুগ পর পুনরায় শুরু হয়েছে। ২০১৪-১৫ সেশন থেকে বিকেএসপি থেকে এইচএসসি পাশ করা ক্রীড়াবিদরা ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এ নিয়মের জন্য বিকেএসপিতে না পড়া বিভিন্ন খেলায় জাতীয় দল, অনূর্ধ্ব পর্যায়ে জাতীয় দলে খেলা ক্রীড়াবিদরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

আবার খেলাধুলায় দুর্দান্ত না হয়েও শুধু বিকেএসপি ও ভর্তি পরীক্ষায় ন্যুনতম পাশ নম্বর নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন অনেকে। ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট সকলেই খেলোয়াড় কোটার বিদ্যমান এই বৈষম্য দূর করার পক্ষে। শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শাহজাহান আলীর কন্ঠে অসহায়ত্বের সুর, ‘এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারকদের বিষয়। একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে আমিও চাই যোগ্য খেলোয়াড়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন শাহরিয়ার নাফীস, ‘খেলোয়াড় পরবর্তী জীবনে যা করছি এর সম্পূর্ণ অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। মার্কেটিং বিভাগের মোরশেদ স্যার, রাজিয়া সুলতামা ম্যাডাম সহ বিভাগের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাদের সহযোগিতার জন্যই আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সুন্দরভাবে শেষ করেছি ও জীবনের বাকিটা পথ চলব।’


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত রয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অধিকাংশ ক্রীড়াবিদ পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। তাই সাবেকদের দাবি অনুজরা যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় হিসেবে পড়ার সুযোগ পায়।


মেজর হাফিজ, আব্দুস সাদেকের মতো স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক তারকা খেলোয়াড় কোটা ব্যবহার না করে মেধা দিয়েই ভর্তি হয়েছেন। গাজী আশরাফ হোসেন লিপু (ব্যবস্থাপনা), গোলাম নওশের প্রিন্স (ব্যবস্থাপনা), ফারুক আহমেদ (লোক প্রশাসন) সেলিম শাহেদ (ফিন্যান্স), দুই গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার (নৃবিজ্ঞান), জিয়াউর রহমান (নৃবিজ্ঞান), হকির টুটুল কুমার নাগ সহ আরো অনেকে। অনেক তারকা ক্রীড়াবিদ খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও পড়াশোনা সম্পন্ন করতে পারেননি। আবার অনেকে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। হ্যান্ডবলের রাশিদা (গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা), ক্রিকেটার শরফুদৌল্লা ইবনে শহীদ সৈকত (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) এদের মধ্যে অন্যতম।


এজেড/এটি