জাপানি অলিম্পিয়ানরা আসবে বাংলাদেশে
অনেক শঙ্কা ছিল টোকিও অলিম্পিক নিয়ে। শেষ পর্যন্ত গতকাল রোববার পর্দা নেমেছে। পদক না পেলেও টাইমিং এবং পারফরম্যান্সের বিচারে এটিই বাংলাদেশের সেরা অলিম্পিক। টোকিও যাওয়ার আগে বাংলাদেশ অলিম্পিকগামী দলের সাথে ভার্চুয়ালি সৌজন্য সাক্ষাত করেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনেও এসেছিলেন ইতো। ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির সঙ্গে টোকিও অলিম্পিক, বাংলাদেশের পারফরম্যান্স, জাপান-বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
প্রশ্ন: আপনি ভ্যাকসিন নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এই কঠিন সময়ে ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করায়, জাপানের কাছে কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ। যাই হোক অলিম্পিক কেমন উপভোগ করলেন?
রাষ্ট্রদূত: জাপান বাংলাদেশের বন্ধুত্ব প্রগাঢ়। জাপান সব সময় বাংলাদেশের পাশে ছিল, আছে ও থাকবে। বাংলাদেশে বসেই অলিম্পিকের বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের খেলা দেখেছি। জাপানের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিটি ইভেন্টের খেলা আমি দেখেছি।
বাংলাদেশ যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পতাকাবহন করছিল আমার খুব ভালো লাগছিল কারণ আমি এখন বাংলাদেশে।
বিজ্ঞাপন
প্রশ্ন: জাপান তিন নম্বর পজিশন থেকে অলিম্পিক শেষ করল…
রাষ্ট্রদূত: শেষ দিনে চীনকে পেছনে ফেলল আমেরিকা। আমরা অধিকাংশ সময় ধারাবাহিকভাবে তৃতীয়স্থানে ছিলাম। আমাদের পজিশনে আমরা সন্তুষ্ট। ১৯৬৪ সালে জাপান সর্বশেষ অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। তখনও জাপান তৃতীয় ছিল। এবারও তৃতীয়। তবে সেই বারের চেয়ে অধিকসংখ্যক স্বর্ণ নিয়ে আমরা এবার তৃতীয় হওয়ায় সন্তুষ্ট। আরেকটি বিষয় খুব লক্ষণীয় স্বর্ণপ্রাপ্ত ও পদকপ্রাপ্ত দেশ উভয়ের সংখ্যা এবার উভয় বেড়েছে। যেটা খুবই ইতিবাচক দিক।
বিজ্ঞাপন
প্রশ্ন: মাঠের পারফরম্যান্সের চেয়ে তো এবার জাপানের মাঠের বাইরের চ্যালেঞ্জ বেশি ছিল। এত কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে অলিম্পিক আয়োজন সম্পন্ন করা।
রাষ্ট্রদূত: অবশ্যই এটা বেশ চ্যালেঞ্জ ছিল। জাপান সেটা দারুণভাবে ব্যবস্থাপনা করে দেখাল। এই করোনা মহামারির মধ্যেও গেমস সুন্দরভাবে আয়োজন করা যায় সেটা জাপান প্রমাণ করল। এখানে শুধু জাপানের অবদান নয়, অংশগ্রহণকারী সকল দেশ এবং মিডিয়ারও অবদান অনেক। আমি বলব সুন্দর এবং সফল অলিম্পিক শেষ হলো। জাপানের এই অলিম্পিকের মাধ্যমে অলিম্পিজমের সুন্দর এক চর্চা হলো।
আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ এবার টোকিও অলিম্পিকস চলাকালীন সময় হিরোশিমা ডে ছিল। টোকিও অলিম্পিকসে থাকা সকলে হিরোশিমা ডে’র বিষয়টি জেনেছে ও অনুধাবন করেছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের কন্টিনজেন্ট টোকিও যাওয়ার আগে আপনি কয়েক দিন তাদের সাথে বেশ সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের পারফরম্যান্স কেমন লাগল?
রাষ্ট্রদূত: আমি খুব আশায় ছিলাম বাংলাদেশ হয়তো তাদের প্রথম অলিম্পিক পদক টোকিওতে পাবে। পদক না পেলেও বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা কিন্তু দারুণ পারফরম্যান্স করেছে। ছয় জনের মধ্যে চারজনই নিজেদের সেরা পারফরম্যান্স করেছে। আগামীতে পদক পাওয়ার সম্ভাবনার বীজ এই অলিম্পিক থেকে বপন হল।
প্রশ্ন: বিশ্ব শতাব্দীতে পদকের লড়াই হতো আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে। একবিংশ শতাব্দীতে সেই লড়াইটা আমেরিকা ও চীনের মধ্যে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন অলিম্পিকের পদকের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একটি বিষয় জড়িত। আপনি একজন কূটনৈতিক হিসেবে কি মনে করেন ?
রাষ্ট্রদূত: বিষয়টি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। যখন স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল ওই সময় আমেরিকা বা সোভিয়েত ইউনিয়েনের একজন অ্যাথলেট পদক পেলে মনে করতো এটা তার দেশের শক্তি বা সামর্থ্যর জন্য কিছুটা হলেও সহায়তা করবে। এখন কিন্তু সেই পরিবেশটা নেই। এখন একজন রাশিয়ান বা আমেরিকান ক্রীড়াবিদ পদক জয়ের পর কিন্তু সেভাবে ভাবে না। সম্পূর্ণ ক্রীড়া মনোভাবেই চলছে অলিম্পিক। তবে এটা ঠিক পদকের জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং পরিকল্পনা অবশ্যই প্রয়োজন। পদক তালিকায় উপরের দেশগুলো আর্থিক সামর্থ্য অনেকটা বেশি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আপনি বলেছিলেন, টোকিও অলিম্পিক থেকে জাপানি অলিম্পিয়ানরা বাংলাদেশে আসবে। অলিম্পিক মাত্র শেষ হলো কবে নাগাদ আসতে পারেন তারা।
রাষ্ট্রদূত: পদকপ্রাপ্ত অলিম্পিয়ান আনতে পারব এই ব্যাপারে আমি কথা দিচ্ছি না। আমার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে পদকজয়ীদের আনা। তবে অবশ্যই জাপানি অলিম্পিয়ানরা (টোকিও অলিম্পিকে যারা জাপানের হয়ে অংশ নিয়েছেন) বাংলাদেশে আসবে। তাদের বাংলাদেশের আনার জন্য আমি কাজ শুরু করব। এখন আগস্ট চলে। এই বছরে যোগাযোগ প্রক্রিয়া এবং পরিকল্পনাতে সময় লাগবে। আগামী বছর সুবিধাজনক সময় জাপানের অলিম্পিয়ানরা বাংলাদেশে আসবে বলা যায়। আগামী বছর বাংলাদেশ ও জাপানের কুটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর হবে। এই উপলক্ষে আমরা ক্রীড়া খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে দুই দেশের ক্রীড়া সম্পর্ককে ভিন্ন উচ্চতায় নিতে অলিম্পিয়ানদের আনার প্রয়াস।
প্রশ্ন: জাপানের সাথে বাংলাদেশের অসাধারণ সম্পর্ক। অলিম্পিক কি সেটা আরো একটু বাড়তি মাত্রা দিচ্ছে বা দিতে পারে কি?
রাষ্ট্রদূত: ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সব দিক থেকেই দারুণ সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে। অলিম্পিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর। সেই অলিম্পিক এবার টোকিওতে হয়েছে। বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেছে ফলে এটা সম্পর্কের বাড়তি একটু মাত্রা আনছেই। বাংলাদেশ সাতার দলকে টোকিওতে জাপানি কোচ সহায়তা করেছে। এটাও কিন্তু সম্পর্কের আন্তরিকতা।
প্রশ্ন: কূটনৈতিক হিসেবে আপনি কি মনে করেন ক্রীড়া কূটনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে?
রাষ্ট্রদূত: অবশ্যই। ক্রীড়া কূটনীতির বড় একটি মাধ্যম। এর মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার ও গতিশীল হয়।
প্রশ্ন: জাপান ক্রীড়াপ্রেমী জাতি। আপনি বাংলাদেশে কয়েক বছর যাবৎ আছেন। বাংলাদেশের ক্রীড়া সংস্কৃতি কেমন লাগছে। জাপান সরকারের বাংলাদেশের অনেক শিক্ষা বৃত্তি রয়েছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোনো শিক্ষা বৃত্তির চেষ্টা করবেন কি ?
রাষ্ট্রদূত: বাংলাদেশে দারুণ সময় উপভোগ করছি। বাংলাদেশে ক্রিকেট বেশি জনপ্রিয়। ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গেও আমি অভ্যস্ত। ভারত ও ইংল্যান্ডে আমি দায়িত্ব পালন করেছিল। সেই সময় ক্রিকেট দেখেছি অনেক। লর্ডস থেকে আমার বাসার দূরত্ব ছিল মাত্র পাঁচ মিনিট। করোনা পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশে এসে ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যাওয়া হয়নি আমার। বাংলাদেশের খেলা দেখতে যাব একদিন।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবলের দুই দলের অধিনায়ক জাপানি। বিষয়টি বেশ গর্বের। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আশা করি কয়েক বছর পর বাংলাদেশের ফুটবলও একটা ভালো পর্যায়ে যাবে।
বাংলাদেশে শিক্ষা বৃত্তি রয়েছে। আলাদাভাবে ক্রীড়াবিদদের জন্য কোনো বৃত্তি নেই। ক্রীড়া সম্পর্কিতও তেমন বৃত্তি নেই। তবে ক্রীড়াবিদরা চাইলে উচ্চ শিক্ষার জন্য আবেদন করতে পারে। জাপানে উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি ক্রীড়া সংস্কৃতিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে তখন। সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে এসে কাজে লাগাতে পারে।
প্রশ্ন: জাপানি ফুটবলার কাতো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের সংকট দূর করেছে। খেলা ছাড়াও অন্য কাজে বাংলাদেশে আসা জাপানিরা খুব অল্প সময়ে দারুণ মানিয়ে নেন। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে জাপানিরা এমন স্বাচ্ছন্দ্য বা নিজেদের মতো মনে করে?
রাষ্ট্রদূত: এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। কাতো এর উজ্জ্বল উদাহরণ। একজন বিদেশি ফুটবলার হিসেবে তার এটি করার কথা ছিল না। সে বাংলাদেশকে ও মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবকে নিজের মনে করেছে। এজন্য ক্লাবকে বাঁচাতে এই উদ্যোগ নিয়েছে।
এজেড/এটি