শিশু হাবিবের আয়ে চলে ৪ জনের সংসার

১২ বছরের শিশু হাবিব। যে বয়সে তার স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া ও সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলায় মেতে থাকার কথা, সেই বয়সে সে সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়েছে। ভাঙারি ও বেলুন বিক্রি করে মা ও তিন ভাইবোনের সংসার চালাচ্ছে হাবিব। সে দিনের বেলায় ভাঙারি কুড়ায় এবং সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেলুন বিক্রি করে।
হাবিব তার মা ভানু খাতুনের (৪০) সঙ্গে কুষ্টিয়া পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের চর মিলপাড়া এলাকায় মজনু আলীর বাড়িতে ভাড়া থাকে। তার বাবার নাম হারুন। পারিবারিক কলহের জেরে প্রায় আড়াই বছর আগে ভানুকে তার স্বামী হারুন তালাক দেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে হাবিব দ্বিতীয়। বড় ভাই বাপ্পি (১৬) ভাঙারির ব্যবসা করে। কিন্তু সংসারের পেছনে খরচ করে না। আট বছর বয়সী ছোট ভাই মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ বাজারে ডাক্তারের দোকানে কাজ করে, সেখানেই থাকে। সবার ছোট ছয় বছর বয়সী বোন। আগে তারা আগে স্কুলে যেত। এখন আর যায় না। মা ভিক্ষা করতেন। এখন আর ভিক্ষা করতে দেয় না হাবিব। তার আয়ের টাকায়েই চলে সংসার।
হাবিব ঢাকা পোস্টকে বলে, আগে আমার মা কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর গেট এলাকায় ভিক্ষা করতেন। রোজার আগে থেকে ভিক্ষা করতে দিই না। মা ভিক্ষা করলে লোকজন খারাপ কথা বলে। মানুষ বলে, ‘এত বড় ছেলে থাকতে মা ভিক্ষা করে, জোয়ান জোয়ান ছেলে মাকে ভিক্ষা করতে পাঠায়। ছেলে কাজ করে মাকে খাওয়াতে পারে না?’ সেজন্য মাকে আর ভিক্ষা করতে দিই না। পৃথিবীর কোনো সন্তান যেন তার মাকে ভিক্ষা করতে না দেয়। সব সন্তানের উচিত আয়-উপার্জন করে মা-বাবাকে খাওয়ানো।
সে বলে, মা বাড়িতেই থাকেন এবং সংসারের কাজ করেন। আমি বড়বাজার থেকে বেলুন কিনি। তারপর প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শহরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেলুন বিক্রি করি। আর দিনের বেলায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ভাঙারি কুড়াই। প্রতিদিন আমার ৩০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা লাভ হয়। আয়ের টাকা মাকে দিই, মা বাজার করেন, সাংসার চালান। আমি দেড় বছর ধরে এই কাজ করি। ভাঙারি কুড়িয়ে কুমারখালী, খোকসাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করি। ভাঙারি কুড়াতে ট্রেনে যাওয়া আসা করি। ট্রেনে যাতায়াত করতে টাকা লাগে না।
হাবিব বলে, আমার বড় ভাই ভাঙারির ব্যবসা করে। কিন্তু সে মাকে টাকা দেয় না। সে তার মতো থাকে, তার মতো খায়। আমি সংসারের খরচ চালাই। খুব আনন্দের সঙ্গে আমাদের সংসার চলে। বর্তমানে অভাব-অনটন নেই, আমাদের সংসার সচ্ছল। প্রতিদিন মাকে টাকা দিই, মা বাজার করেন। মা ও ছোট ভাইবোনের কষ্ট দেখে খারাপ লাগতো। আমরা অনেক সময় না খেয়েও থেকেছি। টাকার অভাবে অনেক সময় খাবার জুটতো না। ক্ষুধার কষ্ট সইতে না পেরে দেড় বছর আগে বেলুন বিক্রি ও ভাঙারি কুড়ানো শুরু করি।
সে বলে, আমার স্বপ্ন একজন ব্যবসায়ী হওয়ার। যখন ব্যবসা করার মতো সাধ্য হবে, তখন সুবিধা মতো পরিকল্পিতভাবে একটা ব্যবসা শুরু করব। পাশাপাশি ভালো চাকরির ব্যবস্থা হলে চাকরি করব। আমি আমার মতো চেষ্টা করে যাব মা ও ভাইবোনকে খুশি রাখার জন্য।
জানা গেছে, প্রায় ১৬ বছর আগে হারুন আলীর সঙ্গ বিয়ে হয় ভানুর। হারুনের বাবার বাড়ি পাবনা জেলায়। বিয়ের পর থেকেই তারা সপরিবারে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ এলাকার হঠাৎপাড়ায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন। সেখানেই সব সন্তানের জন্ম। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে ভানুর বাবার বাড়ি।
ভানু খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামী তালাক দেওয়ার পর থেকে প্রায় দুই থেকে আড়াই বছর ধরে কুষ্টিয়া থাকি। ১৫০০ টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকি। দুই থেকে আড়াই বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সেই সময় আমরা পোড়াদহ থেকে কুষ্টিয়ায় চলে আসি। স্বামীর খোঁজ জানি না। অভাবের কারণে আমি শহরের মজমপুরে ভিক্ষা করতাম। মেজো ছেলে হাবিব ভিক্ষা করতে দেয় না এখন। সে ভাঙারি কুড়িয়ে ও বেলুন বিক্রি করে সংসার চালায়।
তিনি আরও বলেন, হাবিব লাভের টাকা আমাকে দেয় প্রতিদিন। সেই টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া দিই, বাজার করি। হাবিবের আয়ের টাকায় সংসার ভালোভাবে চলে। বড় ছেলেটা টাকা দেয় না। সে আলাদাভাবে চলাফেরা করে, তার মতো আয়-উপার্জন করে, তার মতো খরচ করে। সে আমাদের ঘরের সঙ্গেই আলাদা ঘরে থাকে।
কুষ্টিয়া শহরের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, হাবিব সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন জায়গা, শপিংমলের সামনে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেলুন বিক্রি করে। এছাড়াও সে দিনের বেলায় ভাঙারি কুড়িয়ে বিক্রি করে। সেই টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে। হাবিব ভালো ছেলে। তার মাকে সে ভিক্ষা করতে দেয় না।
হাবিবের বিষয়ে কথা বলতে কুষ্টিয়া পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কিশোর কুমার ঘোষের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
রাজু আহমেদ/আরএআর