বরিশালে ট্রলার নির্মাণশিল্পের নতুন সম্ভাবনা

বর্ষা শেষ হলেই শুরু হয় ডকইয়ার্ড প্রস্তুতির কাজ। আর শীতের শুরুতে অবকাঠামো পায় বঙ্গোপসাগরগামী মাছ ধরার ট্রলার। মিস্ত্রি, স্থানীয় বা ট্রলার-মালিক দৈত্যকার এসব ট্রলারকে বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে সম্বোধন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তারা বলেন ফিশিং বোট।
সরেজমিন দেখা যায়, শীতের মিষ্টি রোদের সূর্য মাথায় নিয়েই তুমুল ব্যস্ততা চলছিল বরিশাল নদী লাগোয়া কীর্তনখোলার নামহীন শাখানদীর ওপারে রসুলপুর বস্তির উত্তর-পশ্চিম কোণে। এখানে ফি বছরই কারও না কারও ট্রলার তৈরি হয়ে থাকে। ফলে ফিশিং বোটের ডকইয়ার্ড নামে সমধিক পরিচিত সরকারি এই এলাকা।
স্থানটির ঠিক পূর্ব পাশে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের দক্ষিণ জোনের শাখা কার্যালয়। একটি সেতু দিয়ে বস্তিটিকে মূল শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলেও দুটি খেয়া চলে দিনের পুরো সময়। দূর থেকেই দেখা যায়, দুটি ট্রলারের মাস্তুল। মিস্ত্রিদের ভাষায়, আধেক কাম শ্যাষ। বাকি কালার পুটিং। পাশাপাশি আরও একটি ট্রলার তৈরিতে হাত দিয়েছেন তারা।
পুরো ১৪ জনের দল শীতের মধ্যেও ঘর্মাক্ত, কর্মক্লান্ত। ভুর ভুর করে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে সবাইকে মন দিয়ে কাজ করতে হাঁক ছাড়েন হেডম্যান বা হেডমিস্ত্রি মো. ইউনুস। কিন্তু যারা নতুন হাতুড়ি পেটাচ্ছেন বা দু-চারটি ট্রলারে কাজ করে হাত অল্প পাকিয়েছেন, তারা অত্যন্ত সম্মান করেন ছিপছিপে গড়নের ৪৫ বছরের এ মানুষটিকে। মূলত তারাই ডেকে থাকেন হেডম্যান বলে।
পটুয়াখালী জেলার মহিপুর থানার বাসিন্দা আনোয়ার খান। তার বাবার হাত ধরেই চট্টগ্রামে ফিশিং বোট তৈরির হাতেখড়ি তার। তিনি বলেন, ১২ বছর বয়স থেকে বোট বানাই। তবে এখন পর্যন্ত পুরো ট্রলার নিজে চুক্তি নিয়ে একটিও করিনি। মূলত হেডম্যান ট্রলার তৈরির চুক্তি করেন। আমরা তার অধীনে কখনো চুক্তিতে আবার কখনো দৈনিক বেতনে কাজ করে থাকি।
রসুলপুরে তৈরি হওয়া ট্রলারে আনোয়ার খান বেতনভিত্তিক কাজ করছেন। তিনি জানান, দৈনিক মুজরিতে ১ হাজার ৩০০ টাকা করে পাচ্ছি। যারা আরও ভালো কাজ পারেন, তারা দুই হাজার টাকাও পান। আবার অনেকে ৫০০ টাকার মজুরিতে আছেন।
‘এক-একটি মাছ ধরার ট্রলার মহাজনের ইচ্ছার ওপরে আকৃতি পেয়ে থাকে’― যুক্ত করেন আনোয়ার। রসুলপুরে যে তিনটি ট্রলার তৈরি করা হচ্ছে, এর সব কটিই একই মহাজনের; একই পরিমাপের। তিনি বলেন, দৈর্ঘ্যে সাড়ে ৫৪ ফুট, উচ্চতায় সাড়ে ১০ ফুট। প্রস্থে পেছনের দিকে ১০ ফুট। তবে মাস্তুলের দিকে পর্যায়ক্রমে প্রস্থমাপ সংকীর্ণ হয়ে আসে।
আনোয়ার বলেন, মাস্তুলটি তৈরি করা হয় একটি আস্ত গাছ দিয়ে। মাস্তুলের গাছটির ব্যাস ন্যূনতম ১০ ফুট হতে হয়। ওদিকে গলুইয়ের নিচটা সাধারণত আট ফুট পরিমাপের হয়। ট্রলারে পাঁচ ইঞ্চি থেকে কমপক্ষে দুই ইঞ্চি লোহা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেহেতু ট্রলারে পুরু কাঠ ব্যবহার করা হয়, সে কারণে মূল কাঠামোতে অধিকাংশ লোহার পরিমাপই হচ্ছে পাঁচ ও চার ইঞ্চি করে।
আনোয়ার হোসেন জানান, বছরে কাজ চুক্তি পেলে ছয়-সাতটি ট্রলার তৈরি করা যায়। এরপর আবার বর্ষা এসে পড়ে। তখন অন্য কাজে যুক্ত হয়ে যান। চলতি বছর এখন পর্যন্ত তিনটি তৈরি করছেন। আরও দুটির চুক্তি রয়েছে তার।
এ বছর শীতের শুরুতেই ডকইয়ার্ডে ট্রলারের কাজের গোড়াপত্তন করেন বরিশালের প্রসিদ্ধ মৎস্য ব্যবসায়ী নগরীর কাঠপট্টি রোডের মনু বাবু। ২০১৮ সালের দিকে আরও দুটি ট্রলার এই ডকইয়ার্ডে তৈরি করে সাগরে নামিয়েছেন তিনি। যদিও ওই বছরেই তার বেশ কয়েকটি ট্রলার সমুদ্রে ডুবে বিশাল লোকসানের মুখে পড়েন। বর্তমানে ঢাকায় থাকায় সরাসরি কথা বলতে পারেননি।
কথা হয় মনু ডকইয়ার্ডের নিরাপত্তাকর্মী আজহার মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলে ডকে। আগে বোট নামানোর এক মৌসুমে বোট খরচ উঠে যেত। কিন্তু বর্তমানে তিন বছরেও খরচ ওঠে না। কতগুলো বোট রয়েছে মনু বাবুর, জানতে চাইলে আজহার বলেন, আমি তো পাঁচ বছর ধরে তার কাজ দেখাশোনা করছি। সঠিক কয়টি আছে, তা বলতে পারব না। তবে দুই দফায় তৈরি করা পাঁচটির মতো হবে।
তিনি আরও বলেন, একটি ট্রলার সর্বোচ্চ ১০ বছর ভালো থাকে। ডকইয়ার্ডে কাজ করেই সংসার চলে আরেক শিক্ষানবিশ মিস্ত্রি হারুন অর রশিদের। তিনি বলেন, আমার বাড়ি পটুয়াখালীর উপকূলে। ২০০৭ সালের সিডরে বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে আরেক মিস্ত্রি আনোয়ার খানের হাত ধরে ট্রলার নির্মাণকাজে লেগে পড়েন। তার সংসারে বা বংশে কেউ ট্রলার মিস্ত্রি না হলেও নিজে কাজ করে সংসার কুশলেই চালাচ্ছেন। ট্রলারে কাজ করে দুটি ছেলেমেয়ের লেখাপড়া করাচ্ছেন।
ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে সময় দিলেন হেডম্যান। ফেনী জেলার মূল শহরের উপকণ্ঠের বাসিন্দা ইউনুস কক্সবাজার জেলার উখিয়ায় ট্রলার তৈরিতে হাত পাকিয়েছেন। উখিয়াতেই থাকেন তিনি। একসময় ওস্তাদের হাত ধরে ট্রলার নির্মাণশিল্পে ঢুকে পড়ার পর এখন পর্যন্ত কতটি ট্রলার তৈরি করেছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান তার কাছে নেই। তবে নিজে হেডম্যান হয়ে মহাজনের সঙ্গে চুক্তি করে এখন পর্যন্ত ১০টি ট্রলার তৈরি করে সাগরে ভাসিয়েছেন।
এক সিএফটির সমান হচ্ছে এক ফুট। আর এসব কাঠের এক সিএফটির দাম ন্যূনতম ১ হাজার ৫০০ টাকা। ২০০০ থেকে ২২০০ টাকাও আছে কিছু গাছের। যুক্ত করেন হেডম্যান ইউনুস। তিনি আরও বলেন, ট্রলার তৈরিতে লোহাকাঠ, গর্জন, কড়ই ও ভাসালু কাঠ ব্যবহার করা হয়। একটি ট্রলার তৈরিতে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস সময় লাগে। ট্রলার তৈরি হয়ে গেলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, মহাজনের সঙ্গে চুক্তি থাকে সাগরে ভাসিয়ে এক দিন চালানোর পর যদি কোনো সমস্যা দেখা না দেয়, তাহলেই মিস্ত্রির দায়িত্ব শেষ।
যদিও ট্রলার সাগরে ভাসানোর চার বছরের মাথায় আরেকবার ডকে তুলতে হয় মেরামতের জন্য। তখনকার কাজের মজুরি আলাদা। আর এখন মিস্ত্রিদের থাকা-খাওয়া ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে থাকেন ট্রলার-মালিক।
ইউনুস মিয়া বলেন, মনু মিয়ার সঙ্গে সাড়ে ২২ লাখ টাকায় তিনটি ট্রলার তৈরিতে চুক্তি হয়েছে তার। এক-একটি ট্রলার নির্মাণে সাড়ে সাত লাখ টাকা করে ধরা হয়েছে। এই চুক্তিও নাকি কম হয়েছে দাবি করে বলেন, কক্সবাজারে এখন বোটপ্রতি আট থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা চুক্তি হচ্ছে। আর আমি তো এই অঞ্চলের সাধারণ ট্রলার নির্মাণের কারিগর না। আমার হাতই শক্ত হয়েছে সমুদ্রের ট্রলার নির্মাণ করে।
একটি ট্রলার নির্মাণে ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় হয় উল্লেখ করে ইউনুস বলেন, কীভাবে কী করতে হবে, তার একটি পরিমাপ হয়ে গেছে। ট্রলার নির্মাণের আগে ছবি এঁকে বা গ্রাফ করে নিতে হয় না। মহাজন যেমন চান, তেমনই প্রস্তুত করে দিই। চোখের মাপ হয়ে গেছে। তা ছাড়া পুরো ট্রলারের চিত্র মাথার ভেতরে থাকে, কীভাবে কী করতে হবে। দীর্ঘ ৩৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, কয়েক বছর আগেও বরিশাল অঞ্চলে ট্রলার নির্মাণে মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল। দিনে দিনে এখন বাড়ছে। এ বছর আরও কয়েকটি কাজের চুক্তি পেয়েছেন।
সরকার এই শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা করলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে। যুক্তি হিসেবে বলেন, নৌ চলাচলের রুট ভরাট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সমুদ্রের মৎস্য আহরণের সম্ভাবনার সহযোগী ট্রলার নির্মাণশিল্প মাছ শিকারের জন্য চাহিদা বাড়িয়েই যাবে, এমনটাই মনে করেন ইউনুস।
এনএ