ক্যানসার নিয়ে রিকশা চালান মজিদুল
রংপুর শহরে রিকশা চালান মজিদুল ইসলাম। রিকশা চালানোর কিছুক্ষণ পরই হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। কারণ তিনি মরণব্যাধি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। এক বেলা কাজ না করলে সংসার চলে না আবার উন্নত চিকিৎসার জন্য নেই পর্যাপ্ত অর্থ। তাই নিজের কথা বাদ দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে অসুস্থ শরীর নিয়েও তাকে রিকশা নিয়ে বের হতে হয়।
রোববার (৩ জুলাই) সকালে নগরীর স্টেশন রোড দাবানল মোড়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করার সময়ে চোখে পড়ে মজিদুল ইসলাম নামের ওই রিকশাচালককে। দেখি রিকশায় বসে হাঁপাচ্ছিলেন তিনি। দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না তার কষ্ট। একটু কাছে যেতেই বোঝা যায়, তার চোখেমুখে অন্ধকারের ছাপ। আকাশপানে তাকিয়ে ওই ব্যক্তি ছাড়লেন দীর্ঘ নিঃশ্বাস। দুহাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে তিনি কিছু একটা চাইলেনও।
এ দৃশ্য দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো কোনো দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়ে শুকরিয়া আদায় করছেন তিনি। কিন্তু যখন রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন চোখে পড়ল অন্য কিছু। রিকশার পেছনে সাঁটানো পোস্টারে লেখা : ‘ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত মজিদুল ইসলাম। আর্থিক সাহায্যের আবেদন’।
রিকশা থামিয়ে কথা হলো ওই চালকের সঙ্গে। জানান, তিনিই মজিদুল ইসলাম। ১৫ মাস ধরে ব্লাড ক্যানসারে ভুগছেন। পরিবারে বিধবা মা, স্ত্রী আর সন্তান। তাদের মুখের দিকে চেয়ে আয়রোজগারে বেরিয়েছেন রিকশা নিয়ে।
পরে তার রিকশায় ভর করে প্রেসক্লাবের দিকে যাওয়ার সময়ে কথায় কথায় উঠে আসে বাঁচার আকুতির প্রার্থনা। প্রেসক্লাবে কাজ সেরে দৈনিক দাবানল অফিসের ভেতরে গিয়ে রিকশায় বসে রক্তে জমাট বাঁধা কষ্টের কথা শোনালেন মজিদুল।
তিনি জানান, তার বসতভিটা নেই। নেই তিন বেলা তৃপ্তি করে খাওয়ার সামর্থ্য। অভাব-অনটনের মধ্যেই বিধবা মা আর নিজ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
মজিদুল ইসলামের বয়স ৪২। বাড়ি লালমনিরহাটের হারাটি ইউনিয়নের মহেন্দ্রনগর কাজীর চাওড়া গ্রামে। তার বাবা মৃত শামছুল ইসলাম, মা বিধবা মর্জিনা বেগম। চার সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে মজিদুল এখন নিঃস্ব। পরিবার নিয়ে ছোট এরশাদুল ইসলামের বাড়িতে ছোট্ট একটি ঘরে থাকছেন তিনি।
বর্তমানে রিকশা চালালেও মজিদুল ইসলাম দীর্ঘ ১৮ বছর লালমনিরহাট-পাটগ্রাম রুটে মিঠু পরিবহন বাসের সহকারী ছিলেন। ২০২১ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নিশ্চিত হন তিনি ব্লাড ক্যানসারে (লিউকোমিয়া) আক্রান্ত।
মজিদুল কাঁদতে কাঁদতে ঢাকা পোস্টকে জানান, আগোত বাসোত হেলপারি করি সংসার আর ছাওয়া (ছেলেমেয়ে) তিনটার পড়ালেখা খরচ চালাইছি। কিন্তু ক্যানসার ধরা পর থাকি মোর সোগ কিছু এলোমেলো হইবে ভাই। জমিজমা যা ছিলো সোগে বিক্রি করি চিকিৎসা করচু। তিন লাখ টাকা খরচ হইছে। এ্যলা আর হাতোত কোনো টাকাপাইসা নাই। রিকশা চালেয়া (চালিয়ে) চিকিৎসার টাকা জোগার সম্ভব না।
তিনি আরও বলেন, মোর দুইটা বেটি আর একটা বেটা ছাওয়া। ইয়ার মদ্দে ব্যাটা কোনাক (ছেলেকে) মাদরাসাত দিচু। আর গত বছর করোনার সময়োত বেটি দুইটাক বিয়াও দিচু। কিন্তু ওমারগুল্যার (তাদের) জনতে কিছুই কইরবার পারো নাই। এ্যলা নিজের চিকিৎসা করিম, না ছাওয়ার লেখাপড়ার টাকার দিম? মাদরাসায় টাকা দিলে তো ব্যাটাটার পড়াশুনা বন্ধ হয়্যা যাইবে। ক্যানসার ধরা পরার পর থাকি খুব কষ্টে দিন যাওছে। মোরো বাঁচার ইচ্ছা জাগে, মুই বাঁচিবার চাও। দেশের বিত্তবান মানুষসহ সরকারের সহযোগিতা দরকার।
গত বছরের এপ্রিলে অসুস্থ হন মজিদুল ইসলাম। টানা চার মাস রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং লালমনিরহাট হাসপাতালে দুই মাস চিকিৎসা নেন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক আহসান হাবীব, চিকিৎসক আশকুল আরেফিনসহ বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের অধীনে ছিলেন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় অথবা ভারতের মাদ্রাজে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এর জন্য সব মিলে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। কিন্তু ভূমিহীন হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে এত টাকা ব্যয় করা সম্ভব নয়। তাই অন্যের সহায়তা ও সহযোগিতার আশায় বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন এই রিকশাচালক।
মজিদুল ইসলাম রংপুর নগরীর আনছারী মোড় এলাকার জব্বার মিয়ার গ্যারেজ থেকে নেওয়া রিকশা চালান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাত্রীদের নিয়ে নগরীর বিভিন্নপ্রাপ্ত ছুটে বেড়ান। রাত হলে আবার সেই গ্যারেজে ফিরে যান। সেখানের রাতযাপন করেন। প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা তার আয় হয়। এর মধ্যে গ্যারেজে রিকশার জমা দিতে হয় ২৫০ টাকা। বাকি টাকা থেকে সংসার ও নিজের টুকটাক ওষুধ কিনে খান।
লালমনিরহাট জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর কার্যালয়ে আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা মেলেনি।
এ নিয়ে সমাজসেবা অফিসার ও সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) উম্মে সালমা রুমা জানান, গত মে মাসের ১০ তারিখে ক্যানসার আক্রান্ত মজিদুল আবেদন করেছেন। আমরা তার আবেদনসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখেছি। আশা করছি দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে তাকে সরকারি সহায়তার অর্থ প্রদান করা সম্ভব হবে।
স্থানীয় হারাটি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম খন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ওই রিকশাচালকের অসুস্থতার কথা শুনেছি। নিজের সামর্থ্য থেকে তাকে ১৫ হাজার টাকা সহযোগিতা করেছি। পাশাপাশি আমি নিজেই তাকে তিন ব্যাগ রক্ত দিয়েছি। তার চিকিৎসার জন্য গ্রামের মানুষসহ দেশের বিত্তবান মানুষ এগিয়ে এলে পরিবারটি উপকৃত হবে।
মজিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে এই ০১৭১০৫৬৫১২৯ (বিকাশ) নম্বরে কথা বলা যাবে। এ ছাড়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক লিমিটেড, লালমনিরহাট হারাটি বন্দর শাখা, হিসাবের নাম মো. মজিদুল ইসলাম, হিসাব নম্বর-১২২/১০৮৯৩ (সঞ্চয়ী) নামে তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
এনএ