মানুষের কাছাকাছি না গেলে কষ্ট কী তা অনুভব করা যায় না

নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো যাদের অবস্থা এবার ঈদেও তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন ক্রিকেটার আরিফা জাহান বিথী। অসহায়, দুস্থ, এতিম, শিখন্ডী, নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষসহ ভাসমান ও বানভাসিদের কেউই বাদ যায়নি বিথীর ভালোবাসা থেকে। ঈদের দিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রংপুরে ১৫০০ পরিবারের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করেছেন তিনি। এ ছাড়া বন্যায় আক্রান্ত ৫০০ পরিবারের জন্য মাংস পৌঁছে দিতে সোমবার (১১ জুলাই) কুড়িগ্রামে যাবেন বিথী।
কয়েক বছর ধরে মানবিক গুণসম্পন্ন ক্রিকেটার আরিফা জাহান বিথী এই কাজটি করে আসছেন। গত বছর বিভিন্নজনের সহযোগিতায় তিনটি গরু ও তিনটি খাসি কোরবানি করে মাংস বিলিয়েছেন তিনি। এবারও তার এ মহতি উদ্যোগে এগিয়ে এসেছে বিন নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন, ডক্টর ফেরদৌসী খন্দকারসহ অনেকেই। যাদের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় এ বছর কোরবানির জন্য কেনা হয় ছয়টি গরু ও পাঁচটি খাসি।
রোববার (১০ জুলাই) ঈদের নামাজের পর একে একে চারটি গরু ও তিনটি খাসি কোরবানি করা হয়। এরপর বিথীর সঙ্গী-সাথীদের নিরন্তন কষ্টে প্রস্তুত করা হয় কোরবানির পশুর মাংস বিতরণের প্যাকেট। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিথী নিজেই রংপুর নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ নূরপুর, মহাদেবপুর, পাটবাড়ি, লালবাগ রেল স্টেশন, শ্যামাসুন্দরী মাঠ ও মণ্ডলপাড়া এলাকার অসহায়-দুস্থ, কর্মহীন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাংসের প্যাকেট পৌঁছে দেন।

এসব এলাকা ছাড়াও সিকিউরিটি গার্ড, এতিমখানা, তৃতীয় লিঙ্গসহ (শিখন্ডী) ভাসমান মানুষদের মাঝে মাংস বিতরণ করেছেন। মানবিক এই সহায়তার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বিথীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১ জুলাই বিথী তার নিজের ফেসবুক আইডিতে বন্যাকবলিত ও অসহায় দুস্থদের জন্য ঈদে কোরবানি করতে সহায়তা চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে লেখা ছিল ‘আপনারা সহযোগিতা করলে ঈদে কোরবানি আয়োজন করব।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিথীর এই মানবিক পোস্ট দেখে অনেকেই সহযোগিতার আশ্বাস দেন। মাত্র আট দিনেই দেশ-বিদেশে থেকে কোরবানির জন্য ছয়টি গরু ও পাঁচটি খাসি কেনার মতো অর্থের যোগান আসে।

ঈদের দিনেও অসহায় ও বানভাসি মানুষদের সঙ্গে ঈদআনন্দ ভাগাভাগি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ক্রিকেটার আরিফা জাহান বিথী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষের কাছাকাছি না গেলে কষ্ট কী তা অনুভব করা যায় না। আমরা বন্যাকবলিত কুড়িগ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানকার মানুষদের মধ্যে সাধ্য, সামর্থ্য ও বিভিন্নজনের সহযোগিতা থেকে ত্রাণ বিতরণ করেছি। ওই সময়ে একজন বানভাসি বলেছিলেন আপা ঈদের দিনেও কি আমাদের এখানে আসবেন? আমাদেরকে কি কোরবানির গোস্ত দিবেন? কিছু না ভেবেই তাকে বলেছিলাম হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ আমাদের তো সব দিনই সমান।
বিথী আরও বলেন, খুব চিন্তায় ছিলাম। আল্লাহ্ আর কিছু মানুষ আমার মনের অবস্থাটা জানতেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি তো নিয়ত করেছিলাম ১ হাজার পরিবারের সাথে ঈদআনন্দ ভাগাভাগি করব। কিছু মানুষের সহযোগিতা, সাহস ও অনুপ্রেরণায় সেটি ২ হাজার পরিবারে গিয়ে ঠেকেছে। আলহামদুলিল্লাহ, সবার অনুদানে এটি করা সম্ভব হয়েছে। মূলত দুস্থ, এতিম, কৃষক, সিকিউরিটি গার্ড, নিন্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং বানভাসি পরিবারের ঈদের আনন্দের জন্যই এই চেষ্টা।

শুধু ঈদ নয়, যেকোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে সাবেক এই নারী ক্রিকেটার বলেন, ঈদের দিনে হয়তো পরিবারের সঙ্গে থাকার কথা। কিন্তু আমার পরিবারের সদস্যরাই আমার এসব কাজের সঙ্গে থাকে। এ কারণে কষ্ট ভুলে থাকি। সত্যি বলতে পরিবারকে তেমন সময় দিতে না পারলেও পরিবারের সবাই আমার সঙ্গে কাজ করছে। আমি ভাগ্যবান একসঙ্গে ২ হাজার পরিবার নিয়ে ঈদআনন্দ উদযাপন করছি।
কোরবানির মাংস কাটাকাটি ও প্যাকেট করতে বিথীকে সহযোগিতা করেছে তার নিজের গড়া উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমির একঝাঁক কিশোরী। মানবিক এ উদ্যোগে অংশ নিতে তার সঙ্গী হয়েছেন বেশকিছু তরুণও। তাদের সঙ্গে নিয়েই প্রায় মাসখানেক ধরে বানভাসিদের কাজ করছেন তিনি। ঈদের দিনটিও বানভাসিদের জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত বিথী। তাই সোমবার (১১ জুলাই) ফের ছুটবেন কুড়িগ্রামের পোড়ারচর, আলোরচর, আফতাবচরে। সেখানে ২টি গরু ও ২টি খাসি কোরবানি করে ৫০০ পরিবারের মাঝে মাংস বিলি করবেন।
তিনি আরও বলেন, মানবিক সহায়তা চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর দেশের এবং প্রবাসের অনেকের কাছ থেকে সাড়া পেয়েছি। সত্যি আমি আনন্দিত, এ রকম কাজ করতে পেরে। বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া মাংসের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুপাতে। যাতে সব পরিবারের সবাই ভালো খেতে পারেন।

বিথী তার উদ্যোগে সহযোগিতার হাত বাড়ানো সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমার একার পক্ষে এত বড় কাজ করা সম্ভব হতো না। যারা আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এই কাজে যারা যারা পাশে ছিলেন, তাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এতগুলো পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগির সময়টা ছিল একদম অন্যরকম। তাদের চোখে-মুখের ভাষা বলে দিচ্ছিল, অসহায় মানুষগুলো কতটা খুশি ছিলেন।
বিথীর অভিমত শব্দ আর আলোর গতির মতো নিয়ম ও কর্ম। শব্দের চেয়ে দ্রুত যেমন আলোর গতি, ঠিক তেমনি কর্মের চেয়ে নিয়তের গতি বেশি। মানুষের অভ্যন্তরীণ বাসনা মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ দেখতে পায় না, আর তাই নিয়তের শুদ্ধতার ওপর মানুষের কর্মকাণ্ড। নিশ্চয় সমস্ত আমলের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রত্যেক মানুষ তাই পাবে, যা সে নিয়ত করবে।
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির শুরুর দিকে সমাজের অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সেবায় মেনে পড়েন আরিফা জাহান বিথী। তার এ উদ্যোগে জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটার সাড়া দেন। গেল সাড়ে তিন বছরে বিশ হাজারের বেশি অসহায়, দুস্থ, কর্মহীন মানুষের পাশাপাশি সন্তানসম্ভবা নারীকে সেবা দিয়েছেন সাবেক এই ক্রিকেটার।

নিজের জমানো টাকা আর অন্যের আর্থিক সহযোগিতার সমন্বয়ে কয়েক হাজার মানুষের দুয়ারে চাল, ডাল, তেল, লবণ, ফল, দুধ, ডিম ও হরলিকসসহ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। রমজানেও অসহায় ব্যক্তিদের হাতে হাতে ইফতার পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এই নারী ক্রিকেটার অন্তত অর্ধশত অসহায় নারীকে সেলাই মেশিন দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন। ঘরহীন বেশ কিছু পরিবারকে দিয়েছেন নতুন ঘর। সহায়-সম্বলহীন শিক্ষার্থীদের অনেককে কলেজে ভর্তির জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন।
এর আগে ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে রংপুর জেলা স্টেডিয়ামে নারীদের জন্য উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি নামে প্রশিক্ষণ একাডেমি গড়েন বিথী। সেখানে ২৫০ জন নারী বিনামূল্যে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
আরিফা জাহান বিথী ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে খেলেছেন। ঢাকার ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, কলাবাগান, রায়েরবাজার ক্রিকেট দলে ওপেনিং ব্যাট করতে নামতেন। ২০১৭ সালে অসুস্থতার কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে পেশাদার ক্রিকেট ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয়েছে তাকে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরআই