চোখে ঝাপসা দেখেন বৃদ্ধা আমেনা, তবুও ঝুঁকি নিয়ে পানি দেন হোটেলে

সড়কের দুই পাশ দিয়ে চলছে যানবাহন। এক পাশ দিয়ে ৬০ বছর বয়সী এক নারী কলস ও পানিভর্তি জার গাড়িতে করে ঠেলছেন। এক চোখে দেখতে পান না, অন্য চোখেও ঝাপসা দেখেন। এভাবেই দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পানি টেনে জীবিকা নির্বাহ করছেন ৬ কন্যার জননী আমেনা বেগম। তিনি নগরীর খালিশপুর দুর্বারসংঘ ক্লাব এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তার স্বামী ফজলুর রহমান ১০ বছর আগে মারা গেছেন।
আমেনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়েদের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন উনি (স্বামী) তো কোনো কাজ করতে পারতেন না। মেয়েরা ছোট ছিল। সংসারে অভাব দেখা দেয়। কী করব? বাধ্য হয়ে হোটেলে পানি দেওয়ার কাজ শুরু করি। প্রথম দিকে হোটেলে পানি দেওয়ায় নুরু ১৫ টাকা দিত। খুব উপকার করত। সবাইরে বলত, উনারে ভাত একটু বেশি দিস। ছোট ছোট মেয়ে নিয়ে থাকে। ওরা আমারে ভাত তরকারি বেশি দিত। পেটের ছেলের চেয়ে উপকার করছে।
তিনি বলেন, দিনে ১৫ টাকা আয় দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন ৮টা দোকানে পানি দিয়ে প্রতিদিন ২০০ টাকা থাকে। এই টাকা দিয়ে সন্তানদের বাজার করে খাওয়ায়, বাড়ি ভাড়া দেই। খুব কষ্ট হয়। সরকার যদি আমারে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিত, খুব উপকার হতো। সারাজীবন তো কষ্ট করলাম। একটা ঘর পাইলে পোলাপান নিয়ে ভালো থাকতে পারতাম।

তিনি আরও বলেন, আইডি কার্ডে আমার বয়স ৫৮ বছর হইছে, এজন্য বয়স্ক ভাতাও পাই না। আমার এক চোখে তো কিছুই দেখি না, আরেক চোখ দিয়ে ঝাপসা দেখি। তোমার (প্রতিবেদকের) মুখ, চেহারা কিছু দেখতে পারছি না। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আমেনা বেগম বলেন, রাস্তা দিয়ে পানি টানার সময় অনেক সময় গাড়িতে লেগে যায়। অনেকে গালিও দেয়, বলে ওই চোখে দেখ না। আমি বলি চোখেই যদি দেখতাম, তাহলে তোমার গাড়িতে তো লাগত না। তাও বেশি কথা কয়। আমার মেয়েটার যদি একটা চাকরিও হইত, তাহলেও বাঁচতাম। তাও তো হইল না।
এই কাজ করে খাওয়াইছি, চারজনের বিয়ে দিছি। আর এখন দুইজন অবিবাহিত আছে। ছোট মেয়ে বিএল কলেজে লেখাপড়া করে। আমি দোকানে পানি টেনে সংসার চালাই। ঘর নেই বাড়ি নেই, ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়।

মাঝে তিন মাস অসুস্থ ছিলাম। নুরু কিছু দিত, মেয়েরা কিছু দিত। সেই দিয়ে চলতাম, খুব কষ্ট হতো। করোনার সময়ও কষ্টে চলছি। আমার এমনই এক কপাল, আমি কোনো জায়গা থেকে একটু ত্রাণ পাইনি। আমার নাকি লাগে না!
চোখের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকে ফ্রি চোখের চিকিৎসার কথা বলেছে। কিন্তু আমি যে যাব, সেই সময়ই তো হয় না। চোখ ঠিক করতে গেলে কাজ বন্ধ থাকবে। তিন মাস ঘরে থাকা লাগবে। তিন মাস ঘরে থাকলে দোকানগুলো ছুটে যাবে। পরে আর কাজে নেবে না। কাজ বন্ধ থাকলে কে খাওয়াবে?
তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করেছি। প্রথম দিকে কল চেপে কোমড়ে কলস নিয়ে পানি টানতাম। হাতে ঠেলা গাড়ি বানিয়েছি এই তিন-চার বছর হলো। এখন একটু সুবিধা হয়। এছাড়া এখন আর কল চাপা লাগছে না, মোটর দিয়ে পানি তুলে নেই। কারেন্ট বিল (বিদ্যুৎ) দিয়ে দেই। এতে সুবিধা হয়, কষ্ট একটু কম হয়।

স্থানীয় একটি হোটেলের মালিক নুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি খুব অসহায় হয়ে ২৫-২৬ বছর আগে বলল, বাবা আমি পানি দেব, আমাকে কাজের সুযোগ দেন। তারপর পানি নেওয়া শুরু করি। কিন্তু সংসার তার চলত না। বিভিন্ন হোটেলে পানি দেয়, প্রতিদিন ২০০-২৫০ টাকা আয় হয়। এই দিয়ে সংসার চলে। তার কোনো বাড়ি-ঘর নেই। শেষ বয়সে এসে যদি সরকারি সহযোগিতা পেত, তাহলে তার উপকার হতো।
হোটেল কর্মচারী মো. ইয়াসিন সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ছোট বেলা থেকে তাকে (আমেনা) পানি টানতে দেখছি। তিনি খুব ভালো মানুষ। ঝুঁকি নিয়ে এই প্রধান সড়কে পানি দেয়। তেমন আয় নেই, ৬ মেয়ে তার। এই বুড়ো বয়সে তার যেন কষ্ট করে না খাওয়া লাগে।
হোটেলে আসা ক্রেতা নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই চাচিকে চিনি। অনেক আগেই তার স্বামী মারা গেছেন। তার কোনো ছেলে নেই। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে দোকানে দোকানে পানি দিচ্ছেন। চাচি ঠিকমতো চোখে দেখেন না। এমন কি ঠিকমতো হাঁটতেও পারেন না। আমার যদি সামর্থ্য থাকত তাহলে সহযোগিতা করতাম।
এসপি