৫২ বছর ধরে গান গেয়ে সংসার চালাচ্ছেন অন্ধ ইবাদুল বাউল

এক হাতের অর্ধাংশ নেই, চোখ অন্ধ, তারপরও জীবন যুদ্ধে থেমে নেই ইবাদুল বাউল (৭২)। দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে গোপালগঞ্জ শহরের বিভিন্ন ফুটপাতে কাটা হাতের অর্ধাংশ দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ও গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।
পরিবারের উপার্জনক্ষম কোনো ব্যাক্তি না থাকায় ফুটপাতে গান গেয়ে নিজের পরিবার চালাচ্ছেন ইবাদুল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে যেতে চান তিনি। ভিক্ষা না করে ভিন্নভাবে উপার্জন করে এক অন্যান্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন ইবাদুল বাউল।
জানা গেছে, ইবাদুল বাউলের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কুশলী গ্রামে। জন্মের আড়াই মাস বয়সে মায়ের ভুলে আগুন পুড়ে যায় তার এক হাত ও দুই চোখ। সেই থেকে দুই চোখ অন্ধ ও ডান হাতের অর্ধাংশ কেটে ফেলতে হয় ইবাদুলের। বাবা-মা বেঁচে থাকা অবস্থায় কোনো কাজ করতে হয়নি ইবাদুলের। কিন্তু ১৫ বছর বয়সে তারা মারা যাওয়ার পর আর বসে থাকতে পারেননি তিনি ।পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় দায়িত্ব কাধে ওঠে তার। সেই থেকে পথে পথে গান গেয়ে পরিবার চালাচ্ছেন তিনি। এভাবেই আয় করে তিন বোনের বিয়ে ও দুই ভাইকে বড় করেছেন এই অন্ধ বাউল।
ইবাদুলের বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আজমির শরীফ যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু কোলকাতায় পৌঁছালে সফর সঙ্গীরা তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। এরপর সেখানকার কয়েকজন অন্ধ ভিক্ষুকের সঙ্গে পরিচয় হয় ইবাদুলের। তাদের কাছ থেকেই শিখেছিলেন হারমোনিয়াম বাজানো ও গান। ওই বছরই কারো একজনের সহযোগীতায় দেশে ফিরে বাস, লঞ্চসহ বিভিন্নস্থানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন।

বর্তমানে গোপালগঞ্জ শহরের বিভিন্ন ফুটপাতে গানের আসর সাজিয়ে বসেন তিনি। ডান হাতের অর্ধাংশ দিয়ে হারমোনিয়ামের বেলো টানেন ও বাম হাত চাবি চেপে সুর তোলেন এরপর নিজের সুরেলা কণ্ঠে গান ধরেন। এভাবেই ৫২টি বছর ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। গান শুনে কারো ভালো লাগলে খুশি হয়ে টাকা দেন। তা দিয়ে চলে তার সংসার। এ সামান্য আয় দিয়েই নিজের তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেসহ মোট চার সদস্যদের সংসার চালান তিনি। সরকারের পক্ষ থেকে ভাতার কার্ড ছাড়া পাননি আর কোনো সহযোগিতা। তাই তো প্রধানমন্ত্রীসহ সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন ইবাদুল বাউল। একটু সহযোগিতা পেলে হয়তো শেষ বয়সটা শান্তিতে কাটাতে পারতেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইবাদুল বাউল ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে এভাবে পথে পথে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করি আমি। আড়াই মাস বয়সে বিছানার পাশে ল্যাম্প রেখেছিলেন আমার মা। সেই ল্যাম্পের আগুন বিছানায় পড়ে দাও দাউ করে জ্বলে উঠে। সেই আগুনে আমার দুচোখ অন্ধ হয়ে যায় ও একহাতের অর্ধেক অংশ কেটে ফেলতে হয়।
১৫ বছর বয়সে আজমির শরীফ যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে ফেলি। পরে ঠাই হয় সেখানকার অন্ধ ভিক্ষুকদের কাছে। তাদের কাছে হারমোনিয়াম বাজানো ও গান গাওয়া শিখি। সেখানকার একজনের সহযোগিতায় ফিরে আসি বাংলাদেশে। এরপর থেকে প্রতিদিন এই গান গেয়ে আমি যে আয় করি তা দিয়েই আমার সংসার চলে। এই সামন্য আয় দিয়েই আমার তিন বোনসহ তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সেই সঙ্গে ছোট ভাইদের বড় করেছি।
চুন্নু মোল্লা নামে এক শ্রোতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইবাদুল বাউলকে আমরা অনেক বছর ধরে চিনি। নব্বইয়ের দশকে লঞ্চঘাটে আমার যখন দোকান ছিল তখন দোকানের সামনে বসে তিনি গান গাইতেন। গান শুনে অনেকে তাকে বিশ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচশ টাকাও দিয়ে যায়। এভাবেই গান গেয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে চলে তার সংসার। এখন দোকান নাই কিন্তু তার গান শুনলে সেখানে বসে যাই। ইচ্ছেমতো গান শোনা হলে তারপর যাই।
ইসলাম নামে আরেক শ্রোতা বলেন, ওনার গান আমার কাছে খুব ভালো লাগে। মাঝে মধ্যে চলার পথে যখনই ওনার গান শুনি সেই জায়গায় বসে পড়ি। গান শোনা শেষ হলে পঞ্চাশ টাকা কিংবা একশ টাকা তার হাতে দিয়ে আসি। আমি প্রায় বিশ বছর ধরে ইবাদুল বাউলকে চিনি। তিনি এভাবেই পথে পথে ঘুরে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ইবাদুল বাউলের স্ত্রী ফতেমা বেগম বলেন, আমাদের পরিবারে আর কেউ আয় করার মতো নেই। আমার স্বামী পথে পথে ঘুরে গান গেয়ে যে টাকা আয় করে তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। এ আয় দিয়েই আমি আমার তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। বড় ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ আর ছোট ছেলে এখনো অনেক ছোট। তাই আয় করার মতো আমাদের পরিবারে আর কেউ নেই।
আরকে