‘ও লাশ বহন করে, ওর গাড়িতে ওঠা যাবে না’
নসিমনের করে মরদেহ বহন করি বলে, কেউ আমার নছিমন ভ্যানে উঠতে চায় না। লোকজন বলে ‘ও লাশ বহন করে ওর গাড়িতে ওঠা যাবে না’। চায়ের দোকানে বসলে কাছ থেকে মানুষ ওঠে চলে যায়। ছেলেটিও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর স্কুলে যেতে চায়না, স্কুলের শিক্ষার্থীরা বলে ওর বাবা লাশ বহন করে ওর সঙ্গে মেশা যাবে না’। এভাবেই নিজের কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন নছিমন চালক লিটন গাজী।
লিটন গাজী মনিরামপুর উপজেলার ফাতেহাবাদ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাতব্বর আলী গাজীর ছেলে। তার কর্মক্ষেত্রের গণ্ডি মরাবাড়ি থেকে থানা আর থানা থেকে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের লাশকাটা ঘর পর্যন্ত। লিটন গাজীর বাবা মুক্তিযুদ্ধের পরে মরদেহ বহন কাজ শুরু করেন। তখন ১২ বছর বয়স থেকে লিটন গাজী তার বাবার সঙ্গে মরদেহ বহনের কাজে সহযোগিতা করতেন। এর ধারাবাহিকতায় বাবার পরে লিটন গাজী গত এক যুগ ধরে এ পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তবে এ পেশায় থেকে লিটন গাজী যেমন সমাজে অবহেলার শিকার হচ্ছেন তেমনি সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ তার।
সরজমিনে লিটন গাজীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার জীবিকার একমাত্র সম্বল একটি ‘নসিমন’। যেটাতে করে তিনি লাশ বহন করেন। যখনই ডাক পড়ে তখনই তার এই তিন চাকার নসিমনটি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। আত্মহত্যা, হত্যা কিংবা অপমৃত্যুর মরা-পচা মরদেহ তিনি এই নসিমনে করে বহন করেন। মামার ঠাই দেওয়া জমিতে বাশের চটা, টিনের বেড়া আর টিনের ছাউনির একটি এক কক্ষের ঘরে তার এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। মরদেহ প্রতি বহন খরচ হিসেবে পান ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। কোনো মাসে দুটি/তিনটি মরদেহ বহন করেন, আবার কোনো মাসে মরদেহ বহনের কাজ থাকেই না। ফলে অনাহারেও দিন কাটাতে হয় তাকে।
লিটন গাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে মাসে লাশ বহনের কাজ পাই না, সে মাসে বেকার হয়ে অনাহারে থাকতে হয়। ভ্যান চালাতে বের হলে আমার ভ্যানে কেউ উঠতে চায় না। তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন- আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সেই হিসেবেও আমরা কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও আমি কোনো সাহায্যে সহযোগিতা পাই না। যখন লাশ বহনের কাজ থাকে না, তখন একটা ঘোড়ার গাড়ি আছে তাতে করে বিছলি বহন করি।
লিটন গাজীর স্ত্রী তানজিলা খাতুন বলেন, স্বামীর এই কাজ সমাজ ভালো চোখে দেখে না। আমার ছেলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ও প্রায়ই বাড়িতে এসে বলতো, যে ওকে স্কুলের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা বলে ‘ওর বাবা লাশ বহন করে’। এগুলো শুনে ও আর স্কুলে যেতে চাইতো না।
লিটন গাজীর প্রতিবেশী কুতুব আলম বলেন, লিটন গাজীরা খুব অভাবী। এদের নিজস্ব ভিটেমাটি নেই। দিন মজুররা তো দিন এনে দিন খেয়ে বেঁচে থাকে, এদের তো তাও হয় না। মাসে দু একটা মরদেহ বহন করার কাজ পায়। ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় কী হয় বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে।
এ বিষয়ে মনিরামপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, লিটন গাজী যে পেশায় নিয়োজিত এটি একটি মহৎ পেশা। আমরা একটি সিআর মামলার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ পাই সেখান থেকে কিছু টাকা লিটন গাজীকে দেই। তবে লিটন গাজী কারও কাছ থেকে একটি টাকাও চেয়ে নেয় না।
এ বিষয়ে মনিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিস্তার ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিটন গাজীকে সহযোগিতা দেওয়া হয়। তিনি যে-সব অভিযোগ করেছেন তার কোনো সত্যতা নেই। তিনি একটা ঘর পাচ্ছেন বলেও শুনেছি।
এ্যান্টনি দাস অপু/এএএ