পিন্টু হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘ভিলেজ পলিটিক্সে’ মত্ত আ.লীগ নেতারা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নে দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স আব্দুল হাকিম পিন্টুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভিলেজ পলিটিক্সে মত্ত হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এতে এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর আলী। তার সঙ্গে আছেন চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরুল মেম্বার ও জুয়েল মেম্বারসহ অন্যান্যরা। আর অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চারবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ রানা টিপু। তার সঙ্গে আছেন আজিজুল ও মিজানুর রহমানসহ অন্যান্যরা।
এ নিয়ে পিন্টু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ২৪ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানায় বাদী হয়ে প্রথম মামলাটি দায়ের করেন পিন্টুর পিতা মো. হুমায়ুন এবং ঘটনার প্রায় ৪০ দিন পর অর্থাৎ গত ৪ মার্চ নিহতের স্ত্রী পারভিন বেগম বাদী হয়ে একই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অপর একটি মামলা দায়ের করেন।
এলাকাবাসীর সূত্র থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন প্রার্থী ছিলেন চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর আলী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শহিদ রানা টিপু। পরে সেই নির্বাচনে ওমর আলী দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন এবং শহীদ রানা টিপু স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন এবং বিজয় লাভ করেন। এই থেকেই তাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয় এবং যা পরবর্তীতে চলতে থাকে। পরে আবারও ২০২২ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নৌকা প্রতীক চান শহীদ রানা টিপু কিন্তু সেইবারও দলীয় মনোনয়ন পান ওমর আলী আর শহীদ রানা টিপু স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এইবারও শহীদ রানা টিপু বিজয় লাভ করেন এবং সেই থেকে এখন অবধি চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতারা কোণঠাসা হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নে ওমর আলী ও শহীদ রানা টিপুর মধ্যে বিরোধ চলতেই থাকে এবং একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স আব্দুল হাকিম পিন্টু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে শুরু থেকেই ভিলেজ পলিটিক্সের খেলায় মত্ত হন ওমর আলী ও শহীদ রানা টিপু।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের সঙ্গে গলায় ফুলের মালা পড়া অবস্থায় ওমর আলী। ছবি: ঢাকা পোস্ট
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আব্দুল হাকিম পিন্টু নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সকে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। ওই রাতে আহত হাকিম পিন্টুকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১০ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ছাড়পত্র দেন এবং তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে এক দিন থাকার পর তাকে আবারও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং ২৩ জানুয়ারি সেখানেই তিনি মারা যান। এরপর ২৪ জানুয়ারি পিন্টুর পিতা বাদী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ রানা টিপুকে ১নং আসামি করে ২০ জনের নাম উল্লেখ ও আরও তিন থেকে চারজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
এরপর হঠাৎ গত ২ মার্চ দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নবাসীর ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এই মানবন্ধনে নিহত আব্দুল হাকিম পিন্টুর স্ত্রী, মেয়ে ও পিন্টুর পিতার দায়ের করা মামলার ১নং আসামি শহীদ রানা টিপুর প্রতিষ্ঠিত কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুস সামাদসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া এই মানববন্ধনের দুই দিন পর ৪ মার্চ নিহতের স্ত্রী পারভিন বেগম বাদী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরেকটি মামলার আবেদন করেছেন। আমলি আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২০৫-এর (ঘ) ধারা মোতাবেক প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে চরবাগডাঙ্গা ইউপি সদস্য মো. জুয়েল রানাকে। অন্য আসামিরা হলেন—চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ওমর আলী, ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম, মতিউর রহমান, মানিক আলী, নাজমুল হক গুধা, মো. সুমন, জাহাঙ্গীর আলী, ইসমাইল হোসেন ও মোশাররফ হোসেন মুসা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আ.লীগ নেতা শহীদ রানা টিপুসহ অন্যান্যরা। ছবি: ঢাকা পোস্ট
মানববন্ধনে নিহত আব্দুল হাকিম পিন্টুর স্ত্রী মোসা. পারভীন বেগম বলেছিলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর আলী, সদর উপজেলা তাঁতী লীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম ও মাদক সম্রাট জুয়েল রানা পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে নির্মমভাবে খুন করেছে। তারা (ওমর আলীসহ তার গ্রুপ) আমার শ্বশুর মো. হুমায়ুনকে প্রভাবিত করে এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে নিরপরাধ মানুষকে মামলায় জড়িয়েছে। তার শ্বশুর তার স্বামীর মরদেহ নিয়ে ব্যবসা করছে বলেও অভিযোগ করেছিলেন তিনি।
তিনি আরও বলেছিলেন, স্বামী হত্যার পর মামলার বাদী হতে চাওয়ার কারণে আমাকে স্বামীর বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এমনকি আমাকে নানারকম ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে এখনও। আমি চাই, সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হোক।
তবে নিহত আব্দুল হাকিম পিন্টুর পিতা হুমায়ুন বলেন, আমার ছেলের বউ ও আমি মিলে সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছি এবং মামলা বর্তমানে চলমান আছে। তারপর আসামিরা বাঁচার জন্য আমার ছেলের বউকে ৮ লাখ টাকা দিয়ে হাত করে নেয় এবং বাদী বানিয়ে আরেকটি মামলা দিয়েছে। আমার ছেলের বউ বর্তমানে টাকার কাছে পুতুল হয়ে গেছে। তাকে যা বলাচ্ছে আসামিরা, তাই সে বলছে।
তিনি আরও বলেন, আমার মামলা দেওয়া আছে এবং মামলা চলবে। তবে আশা করছি আমরা মামলায় বহাল থাকবে। আইনে যা বিচার পাবো, তা আমরা বিচার নেবো।
চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর আলী বলেন, পিন্টু আমার ভাতিজা। তাই তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় মামলা করার বিষয়ে তার পিতাকে আমি সহযোগিতা করেছিলাম। কিন্তু পরে টিপু চেয়ারম্যান পিন্টুর স্ত্রীকে অর্থের বিনিময়ে হাত (ম্যানেজ) করে আমার নামে মামলা দিয়েছে। আমাকে দমানোর জন্য ষড়যন্ত্র করেই এই মামলা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ রানা টিপুর বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি এবং মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তার নম্বরটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য ওবায়েদ পাঠান বলেন, শহীদ রানা টিপু ও ওমর আলী দুইজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা আওয়ামী লীগের প্রভাব বিস্তার করছে এবং এলাকায় বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করছে। হয়তোবা যারা আমাদের দলের আওয়ামী লীগের মনোভাব নিয়ে চলাফেরা করে তারা তাদেরকে সার্পোট দিচ্ছে। এটা আমরা আকার ইঙ্গিতে বুঝতে পারছি। তারপরও আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করবো তাদের সিন্ডকেটের কোমর যেন ভেঙে দেওয়া হয়।
চাঁপানবাবগঞ্জ জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিকে (সুজন) সম্পাদক মনোয়ার হোসেন জুয়েল বলেন, গত ১২ জানুয়ারি আব্দুল হাকিম পিন্টুকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। ১০ থেকে ১২ দিন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকার পর পিন্টু মারা যান। কিন্তু চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার পরিবার আইনি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মারা যাওয়ার পর মামলা দায়ের করে পিন্টুর পিতা হুমায়ুন। কিন্তু স্থানীয় ভিলেজ পলিটিকসের কারণে তার পরিবারের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয় এবং তার পরিবার দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এতে স্পষ্ট যে এক পক্ষ সত্য বলছে আর আরেক পক্ষ মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। তাই চরাঞ্চলের ভিলেজ পলিটিকসের কারণে পিন্টু মামলার সঠিক তদন্ত ব্যাহত হবে বলেও মনে করছি। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনেক ডেভিল আছে। তা আমরা সবাই জানি কিন্তু প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে প্রশাসনের গাফলতি স্পষ্ট বলেও মনে করছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মতিউর রহমান বলেন, পিন্টুর বাবা হুমায়নের দায়ের করা মামলায় ২০ জন এজাহারনামীয় আসামির মধ্যে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ এবং বাকি আসামিদের আটক করতে কাজ করছে তারা। মামলার তদন্ত কাজ চলমান আছে।
এ ছাড়া পিন্টুর স্ত্রীর আদালতে আরেকটি মামলা করার বিষয়ে ওসি মতিউর রহমান বলেন, এটি তার (পিন্টুর স্ত্রীর) নাগরিক অধিকার। তিনি মামলা করতে পারেন। আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা আসলে সেই বিষয়টি নিয়েও কাজ করবো আমরা। তবে বর্তমানে আমরা পিন্টুর বাবার দায়ের করা মামলাটি ফোকাস করে কাজ করছি এবং তদন্ত কাজে যেন কোনো প্রকার বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখছি।
মো. আশিক আলী/এএমকে