চারজন চিকিৎসক দিয়ে চলছে পৌনে ৩ লাখ মানুষের চিকিৎসা

উত্তরে ভোলা সদর। দক্ষিণে লালমোহন। মাঝখানে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা। যুগের পর যুগ ধরে যথাযথ চিকিৎসাসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এ উপজেলার বাসিন্দারা। চিকিৎসক, নার্স, আধুনিক ভবনসহ রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি সংকটে ধুঁকছে বোরহানউদ্দিনের ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে রয়েছেন মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তরা। রোগী ও স্থানীয়দের অভিযোগ এটি নামেমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মেলে না যথাযথ চিকিৎসা।
সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে বাধ্য হয়েই সেখানকার বাসিন্দাদের কেউ কেউ যাচ্ছেন বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে। এতে তিন থেকে চারগুণ বেশি টাকা খরচ হচ্ছে তাদের। ফলে ক্ষুব্ধ তারা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ভোলা জেলা অফিসের তথ্য মতে, বোরহানউদ্দিন উপজেলায় বসবাসকারী মানুষ রয়েছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার ৪৩৭ জন মানুষ। বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য মতে, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩০টি ও নার্সের পদ রয়েছে ৩৭টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন টিএসসহ মাত্র ৫ জন চিকিৎসক ও ১৪ জন নার্স। ফলে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসকের শুন্য পদ রয়েছে ২৫টি ও নার্সের ২৩টি।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রতিদিনই চিকিৎসা নিতে আসছেন আন্তঃবিভাগ ও বর্হিবিভাগ মিলিয়ে প্রায় ধারণক্ষমতার চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুন রোগী। অন্যদিকে, জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চলছে ৩০ শয্যা নিয়ে। গত ১৫ দিনে আন্তঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৪৩ জন নারী-পুরুষ ও শিশু ও বহিঃবিভাগে প্রায় আড়াই হাজার। যাদের অধিকাংশই নারী-শিশু,জ্বর ঠান্ডাসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত।
সরেজমিনে দেখা যায়, মূল ফটকের সামনে পুরোনো একটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে জরুরি বিভাগ, ভেতরে খসে পড়া অবস্থায় রয়েছে ছাদের প্লাস্টার, বেরিয়ে এসেছে রড। ভবনটির ভেতরে একপাশে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কক্ষ, অপরপাশে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের কক্ষসহ দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য কয়েকটি কক্ষ, সেখানেই অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে নিয়মিত বসছেন তারা।
পুরোনো ভবনটির পেছনে রয়েছে প্রায় ১ যুগ আগে নির্মিত আরেকটি ১৯ শয্যার ভবন। অতিরিক্ত রয়েছে আরও ১১টিসহ মোট ৩০টি বেড। ওপর তলায় চলছে আন্তঃবিভাগ ও নিচ তলায় বহিঃবিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম। আন্তঃবিভাগের অন্যান্য রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন মেঝেতে,নেই অপারেশন থিয়েটার। অন্যদিকে, ধারণক্ষমতার চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুন বেশি রোগীদের চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম অবস্থা চিকিৎসক ও নার্সদের।
বাধ্য হয়েই চিকিৎসা নিতে হয়
আমার স্বামী গাঙ্গে (নদীতে) মাছ ধরে। ছেলে-মেয়ে লইয়া (নিয়ে) ৫ জনের সংসার। স্বামী ছাড়া আর কেউ কামাই (আয়) করার নাই। ছোডো পোলাডার ৫ দিন ধইরা জ্বর-ঠান্ডা, বোরহানউদ্দিন হাসপাতালে আইন্না (এনে) ভর্তি করাইছি। হাসপাতালে ভর্তির পর একবার ডাক্তার আসছিল, এক নজর দেইখা গেছে, এরমধ্যে আর আসেনি। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেল। নার্সদের ডাকলেও তারা আসতে চান না। আমরা গরিব মানুষ, অন্য কোথাও পোলারে চিকিৎসার জন্য নেওয়ার সামর্থ্য নাই, কি করব? এভাবেই ঢাকা পোস্টের কাছে অভিযোগ করছিলেন চিকিৎসাধীন শিশু মো. ওসামার মা মাইমুনা।
প্রায় একই অভিযোগ রোগী রাবেয়া বেগমের। তিনি বলেন, আমাদের টাকা থাকলে এখানে চিকিৎসার জন্য আসতাম না, বরিশাল বা ঢাকা যেতাম চিকিৎসার জন্য।
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসার জন্য ষাটোর্ধ্ব মোতাহার হোসেনকে তার স্বজনরা এনেছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে। সেখানে কর্মরতরা রোগীর স্বজনদের রোগীর ইসিজি করানোর জন্য বলেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইসিজি মেশিন নেই জানান তারা।

মোতাহারের স্বজনরা বলেন, আমরা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরে বোরহানউদ্দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যন্ত্রপাতি নেই। যদি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইসিজি মেশিন থাকতো তাহলে বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে হতো না। সরকারিভাবে স্বল্পমূল্যে পরীক্ষা করাতে পারলে কম টাকা লাগে। তাছাড়া পরীক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে এক্সরে মেশিনও নেই।
ক্ষুব্ধ বোরহানউদ্দিনবাসী
স্থানীয় বাসিন্দা মো.শফিউল্লাহ, মো. বশার ও আমজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা প্রায় পৌনে ৩ লাখ লোক বসবাস করি এ উপজেলায়। বেশিরভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে যে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোথাও গিয়ে চিকিৎসা নেবে সেই সামর্থ্য অনেকের নেই। অনেকটা বাধ্য হয়েই বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে হয়। অন্যদিকে, কথায় কথায় এখান থেকে রোগীদের ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করে দেওয়া হয়। এখানে চিকিৎসক ও নার্সের তীব্র সংকট। এছাড়া হাসপাতালে রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও নেই। ৩ থেকে ৪ গুন বেশি টাকা খরচ করে বাইরে থেকে পরীক্ষা করতে হয়। সব মিলিয়ে বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নামেমাত্র চিকিৎসা সেবা চলে।
নানা অসুবিধায় রোগীর স্বজনরা প্রায় সময়ই ক্ষিপ্ত হয়ে নার্সদের সাথে অসদাচরণ করে বলে আক্ষেপ করে জানান বোরহানউদ্দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স সম্পা বেপারি। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে নার্স সংকট, বেড সংকটসহ অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। এসব সংকটের মধ্যেও আমরা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। কর্তৃপক্ষ নার্স সংকটের সমাধান করলে আমরা আরও ভালোভাবে রোগীদের সেবা দিতে পারতাম।
বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নিরুপম সরকার সোহাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে চিকিৎসক-নার্স ও রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। মাত্র ৪ জন চিকিৎসক ও ১৪ জন নার্স দিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। আন্তঃবিভাগ বহিঃবিভাগ মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ জন রোগী চিকিৎসা নেন। প্রচুর রোগীর চাপ থাকে। এটি ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হলেও পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে আন্তঃবিভাগের সকল রোগীকে বেড দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটি আধুনিক ভবনও প্রয়োজন। এসব সমস্যায় সেবা কিছুটা ব্যহত হচ্ছে।
যা বলছেন ভোলার সিভিল সার্জন
আগামী ২ মাসের মধ্যে চিকিৎসক ও নার্স সংকট কেটে যাওয়ার আশা করছেন ভোলার সিভিল সার্জন ডা.মু.মনিরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুইমাসের মধ্যে চিকিৎসক নিয়োগ হবে। নার্সদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তারা শুন্য পদে যোগদান করলে বোরহানউদ্দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক-নার্স সংকট কেটে যাবে। যেহেতু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পুরোনো ভবনটি জরাজীর্ণ তাই সেখানে বেড স্থাপন করা সম্ভব না। ১৯ বেডের ভবনে ৩০ বেড দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এক্সরে মেশিন অকেজো, টেকনোলজিস্ট নেই, সার্জন ও এনেস্থেসিওলজিস্ট না হলে অপারেশন থিয়েটার চালু করা সম্ভব নয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয় জানিয়েছি। আশা করছি দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান হবে এবং সেখানাকার বাসিন্দারা যথাযথ চিকিৎসা সেবা পাবেন।
এদিকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে অতিদ্রুত বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন রোগী ও বাসিন্দারা।
এমএএস