তিস্তাপাড়ে ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ, থেমে নেই ড্রেজিং

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর শ্রাবণের বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পেটে পানিতে টইটম্বুর। পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও তীব্র স্রোত আর ভাঙনে আতঙ্ক বাড়ছে নদীপাড়ের জনবসতিজুড়ে। বিশেষ করে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বুক চিরে বয়ে চলা রাক্ষুসে তিস্তা যেন নদী-তীরবর্তী এলাকার মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
এদিকে নদী ভাঙনরোধে জিও ব্যাগ ফেলানোর উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। অন্যদিকে এলজিইডি কর্তৃক প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নদীর পেট থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে প্রকল্প ঘেঁষে। এতে নদীপাড়ে ভাঙনের ভয়াবহতা বেড়েছে কয়েকগুণ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, উপজেলার নদী-তীরবর্তী ছাওলা ইউনিয়নের বোল্ডারের মাথা পর্যন্ত এলজিইডির একটি সড়ক পাকাকরণের জন্য বালু উত্তোলনে পাশের তিস্তা নদীতে বসানো হয়েছে ড্রেজার। সেখান থেকে রাত-দিন বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের আশঙ্কার পাশাপাশি জিও ব্যাগ ফেলানোর কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব এলাকায় বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তার করাল গ্রাসে বিলীন হচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি। ইতোমধ্যে অর্ধশত বাড়িঘর ভাঙনের কবলে পড়েছে। ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। একইসঙ্গে নদীর তীর ঘেঁষে বসানো ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জিও ব্যাগ কার্যত কোনো কাজে না আসার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভাঙনের মুখে পড়ে অনেকে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু আশপাশে নিরাপদ জায়গার অভাবে নতুন করে বসতি গড়ার জায়গা পাচ্ছেন না অনেকে। আতঙ্কে দিন পার করছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। তিস্তাপাড়ে বসবাসকারী মানুষ বলছে, ভাঙন ঠেকাতে একপাশে উদ্যোগ আর অন্যপাশে ধ্বংস, এই দ্বৈত অবস্থান না থামলে, আমাদের মতো পরিবারগুলো তিস্তার গর্ভেই বিলীন হয়ে যাবে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী বলেন, একদিকে সরকার জিও ব্যাগ দিচ্ছে আরেকদিকে তাদেরই এলজিইডি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ড্রেজার বসিয়ে নদী খুঁড়ছে। এটা কি মানুষ নিয়ে তামাশা নয়? আমরা তো সাধারণ মানুষ, আমাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। বহুবার নিষেধ করেও বালু উত্তোলন বন্ধ করা যায়নি।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবু সাঈদ বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরামর্শেই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এটা যদি সরকারি উদ্যোগে হয়ে থাকে তাহলে আমার আর কি করার আছে।
ছাওলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নাজির হোসেন বলেন, গত কয়েকদিনে ৪৯টি বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। এখানে কমপক্ষে ২০ হাজার জিও ব্যাগ দরকার। যা বরাদ্দ হয়েছে, তা দিয়ে ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না। তবে তিনি বালু উত্তোলন নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ মো. রাসেল বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকায় বালু উত্তোলন ঝুঁকিপূর্ণ। বালু উত্তোলন বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মোহাম্মদ সরফরাজ বান্দা বলেন, এটা আমরা জানি না। যদি এমনটা হয়ে থাকে, তদন্ত করে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
এদিকে তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করলেও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মেলেনি নদীপাড়ের মানুষদের। রংপুরের কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া ও পীরগাছা উপজেলার বিভিন্ন চরগ্রামে ফসলি জমি ও বীজতলা তলিয়ে গেছে। বন্যার পূর্বাভাস থাকায় অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে উঁচু জায়গায় সরে গেছেন।
কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের হাজীটারী গ্রামে তিস্তা নদীর গর্ভে আবাদি জমি বিলীন হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কৃষক মতলুব মিয়া। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ কোনো রকমে চাষাবাদ করি। সেটাও এখন নদী ভাঙনের মুখে। এভাবে প্রতিবছর নদী ভাঙনে আমরা নিঃস্ব হচ্ছি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। অথচ আমাদের তিস্তাপাড়ের মানুষকে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল ৯টায় নীলফামারীর ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৯.০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই সময়ে রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ ছিল বিপৎসীমার ৬৪.০ সেন্টিমিটার নিচে। পানি সামাল দিতে তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে ৪৪টি স্লুইসগেট (জলকপাট) খুলে রাখা হয়েছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে