ওয়ার্কশপের কাজ ছেড়ে এখন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, লাখ টাকা আয় হৃদয়ের

ফেসবুকে কন্টেন্ট তৈরি করে বেশ সাড়া ফেলেছেন জোবায়ের হোসেন হৃদয় (২৪)। পড়াশোনায় অমনোযোগী হৃদয় শেষ করতে পারেনি প্রাথমিকের গণ্ডি। তবে এখন ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে সাড়া ফেলেছেন নিজ এলাকাসহ পুরো বাংলাদেশে।
হৃদয়ের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ভাউকসার ইউনিয়নের ছোট লক্ষ্মীপুর গ্রামে। তার বাবা মো.কবির হোসেন একজন প্রবাসী। মা গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে হৃদয় সবার বড়।
কাজ করতেন একটি লাকসাম উপজেলার একটি ওয়ার্কশপে। ২০১৩ সাল থেকে ভিডিও ফটোগ্রাফির কাজ শুরু করেন বিজরা শাপলা স্টুডিওতে। স্টুডিওতে যখন থাকতেন বিভিন্ন বিয়ের প্রোগ্রাম করতে হতো। তখন থেকেই ভিডিও বানানোর ভুত মাথায় চেপে বসে তার। তার ‘হালকা ওয়াশ’ ফেসবুক পেজের এখন ৮ লাখ ১৭ হাজার ফলোয়ার। দক্ষিণ কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় ভিডিও বানিয়ে কন্টেন্ট তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন হৃদয়।
কন্টেন্ট তৈরির শুরুর দিকে পাড়া প্রতিবেশির নানান কটুকথা আর বিষোদগার পোহাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সেসব কথায় দমে না গিয়ে চালিয়ে গেছেন কাজ, পেয়েছেন সফলতা। সফল হওয়ার পর কটুকথা বলা লোকজন হৃদয়কে কাছে টেনে নিয়েছেন।
হৃদয় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভিডিও বানানোর প্রথম মাধ্যম ছিল লাইকি সফটওয়্যারে। তখন জীবন মাহমুদ ভাই কনটেন্ট ক্রিয়েটর পরিচিত মুখ ছিলেন। একদিন শুনলাম ওনি আমাদের পাশের গ্রামে এসেছেন। তাড়াহুড়ো করে চলে যাই পরিচিত হতে। তারপর ওনার সঙ্গে ফানি ভিডিও বানানোর জন্য দাদুর থেকে ১৫০০ টাকা নিয়ে ঢাকা চলে যাই। সেখানেও বেশিদিন থাকা হয়নি। কিছুদিন পরই বাড়ি ফিরে আসি।
বাড়ি এসে শুনি আমাদের পাশের গ্রামের কবির হোসেন নামে একজন ভিডিও বানায়। কবির রাতারাতি অনেক জনপ্রিয় হয়ে যায় বিভিন্ন কারণে। তারপর কবিরের সঙ্গে দেখা করি। সে একদিন আমাকে বলল একটা ফেসবুকে পেইজ খুলতে। তার কথা অনুয়ায়ী পেইজ খুললাম। আমার পেইজের নাম হালকা ওয়াশ, এটাও আমার বন্ধু কবিরের দেওয়া।
পরের দিন একটা ফানি রোস্ট ভিডিও আপলোড করি। পেইজে তখন ফলোয়ার সংখ্যা ৫ জন, কিন্তু সে ভিডিও ভিউ হয় ৫ হাজার। তখন থেকেই মনে হয়েছে আমি ফানি ভিডিও করলে কিছু একটা করতে পারব। এর মধ্যেই ফেসবুকে রিপা আক্তার (টুনি) এর সঙ্গে পরিচয়। রিপার বাড়ি ছিল সাভারের হেমায়েতপুর গ্রামে। কথা বলার কয়েক মাস পরে আমরা দুইজন বিয়ে করে ফেলি। তখন ফেসবুকে বিভিন্ন ভিডিও বানালেও মনিটাইজেশন না থাকায় আয় আসতো না।

তারপর আয়ের খোঁজে টুনিকে নিয়ে কুমিল্লা ইপিজেডে ঢুকে যাই। সেখানে একটা কোম্পানিতে চাকরি করি আমরা দুইজনেই। সারাদিন ঘুরাঘুরি করা ছেলেটা যখন বন্দি হয়ে গেলাম, তখন মনে হতো কবে যে এই জেল থেকে মুক্তি পাব। ১ মাস চাকরি করার পর টুনিকে নিয়ে বাড়ি চলে আসি। বাড়ি এসে কন্টেন্ট বানানোর কাজে মন দেই।
হৃদয় বলেন, ২০২২ সালে পেইজ মনিটাইজেশন পাই। তখন থেকে ৩ মাস পর পর ১৫/২০ হাজার করে পেতাম। তখন টুনিকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাই।সেখানে পরিচিত ভাইদের সঙ্গে ভিডিও বানাতে শুরু করি। কিন্তু গ্রামের ছেলে শহরে মন বসাতে পারলাম না। প্রায় ৮ মাস ঢাকায় থাকার পর আবার বাড়ি চলে আসি। বাড়ি এসে প্রতিদিন কমপক্ষে ১টা হলেও ভিডিও দিতাম পেজে। তখনই আল্লাহ আমার দিকে মুখ ফিরে তাকিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই আমার অনেক ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমার মূল ফোকাস ছিল আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে ভিডিও বানানো। এটাতে আমি সফল হয়েছি। আমার এক মাসে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ইনকাম হয়েছিল। এখন আবার বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের জন্য কল পাই। এখান থেকে কিছু হাত খরচ আসে।
হৃদয় আরও বলেন, ফেসবুকের আয় দিয়ে গত বছর আমার স্বপ্নের বাইক কিনলাম ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে। আর আরেকটা স্বপ্ন- একটা প্রাইভেটকার কিনব। সেটাও বাস্তবায়ন করলাম এই বছর। কিছুদিন আগে একটা প্রাইভেটকার কিনেছি ১০ লাখ টাকা দিয়ে। এখন আমার নতুন আরেকটি স্বপ্ন হলো। বাংলাদেশের সব জেলায় হালকা ওয়াশ নামের প্রতিষ্ঠান থাকবে। আর প্রতি জেলার গ্রামীণ দৃশ্য নিয়ে ভিডিও বানানো।
হৃদয় বলেন, আসলে ফেসবুক, ইউটিউব খুবই সাধারণ জায়গা। কারণ এখানে নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে একটা ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। যেখানে টাকা, সম্মান আর মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়। তবে আপনাকে লেগে থাকতে হবে। শুরু করতে হবে। ধৈর্য্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই সাফল্যের দেখা পাবেন।
হৃদয়ের স্ত্রী রিপা আক্তার টুনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, হৃদয়ের সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হয়, তখন অনেক কষ্টে আমাদের জীবন চালাতে হয়েছে। আমরা তখন ঢাকাতে ছিলাম। ঘর ভাড়াও দিতে পারতাম না। আমার নানুর বাড়ি থেকে টাকা এনে ঘর ভাড়ার টাকা দিতাম। যখন আল্লাহ আমাদের দিকে তাকিয়েছে তখন মানুষের কটু কথা শুরু হয়। আমাকে নিয়ে কেনো ভিডিও বানায়,আমি কেনো ভিডিওতে থাকি এগুলা নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমাদের। আমরা সবার কটু কথাকে আশীর্বাদ মেনে কাজ চালিয়ে যেতাম। এখন আমরা খুব ভালো আছি।কোন জায়গায় গেলেও মানুষ খুব সম্মান দেয়। দেশবাসীর কাছে আমরা দোয়া প্রার্থী।
হৃদয়ের চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হৃদয় খুব কম বয়সে ভালো পরিচিতি পেয়েছে। দিনরাত পরিশ্রম করে কনটেন্ট তৈরি করে আজ একটি পর্যায়ে এসেছে। আমরা দেখতাম রাত নেই, দিন নেই সারাক্ষণ ভিডিও বানানো নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তার কঠোর পরিশ্রমই তাকে সফলতা এনে দিয়েছে। একটা সময় সমাজের সবাই তাকে বাঁকা চোখে দেখতো। আজ সে সফলতা পাওয়ার পর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে।
হৃদয়ের মা জাহানারা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলেটাকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় থাকতাম। প্রতিদিন বিভিন্ন লোকজন এসে আমার কাছে নালিশ করত। আমার ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে, বাজে পথে চলে গেছে। আমিও তাকে বকতাম। কিন্তু, সে কোনো কিছুতেই কান দিত না। সে তার কাজ করে গেছে। এখন আলহামদুলিল্লাহ সবাই খুব প্রসংশা করছে। হৃদয়ের জন্য অনেক মানুষের কটুকথা শুনেছি। এখন আর কেউ সেসব কথা বলে না।
আরিফ আজগর/আরকে