বাসের ভেতর পুড়ে মারা যায় শাহাবীর, ৮ মাসেও ক্ষতিপূরণ পায়নি পরিবার

বাসের ভেতর আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় ১৪ বছরের শাহাবীরের। ছেলের মরদেহটিও দেখেতে আসেনি তার বাবা সোহেল মিয়া। শাহাবীরের বয়স যখন ৭ বছর তখন তার বাবা সোহেল মিয়া তাদের ছেড়ে চলে যান। এরপর মা মুন্নী বেগম ছেলে শাহাবীর ও মেয়ে সোহানাকে নিয়ে আশ্রয় নেন বাবার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পালগাঁও গ্রামে। নানার সংসারে অভাব অনটন ও মা-বোনের দুঃখ লাঘব করতে শাহাবীর লেখাপড়া ছেড়ে প্রথমে লেগুনার পরে বাসের হেলপারের কাজ শুরু করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বাসের ভেতরেই আগুরে পুড়ে অকাল মৃত্যু হয় তার।
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বালিগাঁও ব্রিজের ওপরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি পার্কিং করা বাসের ভেতরে রাত্রিযাপনকালে মশার কয়েল থেকে পুরো বাসে আগুন ছড়িয়ে পড়লে ঘুমন্ত অবস্থায় হেলপার শাহাবীর মিয়া (১৪) মারা যায়। সে মুন্সীগঞ্জের বালিগাওঁ হতে ঢাকায় যাতায়াত করা গাংচিল পরিবহনের ঢাকা মেট্রো ব-২৮৩১ গাড়ির হেলপার ছিল। শাহাবীরের মৃত্যুর ঘটনায় টঙ্গিবাড়ী থানায় বসে বাসের মালিক পক্ষের তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা হয়। তবে আজ ৮ মাসেও সেই টাকার সবটা বুঝে পায়নি মৃত শাহাবীরের মা ও বোন। টাকা পাওয়ার জন্য মৃত শাহাবীরের পরিবার বারবার পরিবহন কর্তৃপক্ষকের কাছে ধরনা দিলেও কোনো লাভ হয়নি।
সরেজমিনে শাহাবীরের নানা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অভাব-অনটনে কাটছে মৃত শাহাবীরের মা মুন্নী বেগম ও তার বোন সোহানার জীবন। মুন্নী বেগম তার বাবা মজিবুর পাঠানের বাড়িতে দিনের বেলা এক সঙ্গে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ পেলেও রাতে ঘুমাতে হয় অন্য জায়গায়। ওই বাড়িতে রয়েছে দুটি টিনের ভাঙাচোরা ঘর। ওই ঘরে মুন্নী বেগমের দুই ভাই ও তাদের পরিবারও থাকে। কিছুদিন আগে মুন্নী বেগমের আরেক বোন মমতাজের স্বামী মারা যাওয়ায় সেইও তাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছে। তাই বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে তিনি রাতে তার চাচাতো ভাই মিজানুর রহমানের পরিত্যক্ত ঘরে থাকে।
মুন্নী বেগম ও তার পরিবার এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫ বছর আগে পারিবারিকভাবে মুন্নী বেগমের বিয়ে হয় ঢাকার ধোলাইপার এলাকার সোহেলের সঙ্গে। তারা ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় ভাড়া থাকতে শুরু করেন। সেখানে ভাড়া থেকে অটোগাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন সোহেল। পরে বন্ধুদের পাল্লায় নেশা জড়িয়ে পড়ে সোহেল। ৭ বছর আগে স্বামীর মারধরে অতিষ্ঠ হয়ে সংসার ছেড়ে মুন্নী বেগম ছেলে শাহবীর ও মেয়ে সোহানাকে নিয়ে আশ্রয় নেন বাবা বাড়িতে। সেখানে ছেলে ও বাবার উপার্জনে কোনো মতে চলছিল তাদের জীবন। এরই মাঝে শাহবীরের হঠাৎ মৃত্যু তাদের জীবনকে থমকে দিয়েছে যেন। বর্তমানে অভাব-অনটনে জর্জরিত মা-মেয়ের জীবন। মেয়ে সোহানা এখন পালগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।
মৃত শাহাবীরের নানা মুজিবর পাঠান বলেন, আমি গ্রাম্য পুলিশ। আমার বয়স হয়েছে। শারীরিক অবস্থা খারাপ। যা পাই তা দিয়ে নিজেরই চলে না। তিন ছেলে, দুই মেয়ে আমার। মেয়ে দুইটা এখনো আমার কাছেই থাকে। আগে থেকেই আমি শাহাবীর ও তার মা-বোনকে পালছি। নিজের অল্প আয় থেকে ওর জন্য সব করার চেষ্টা করি। ওর মেয়ে সোহান স্কুলে পড়ে। সোহানার খরচও আমার দিতে হয়। আমি আমার নাতি শাহাবীরকে নিষেধ করেছিলাম বাসের হেলপারি করতে। কিন্তু আমার সংসারে অভাব অনটন দেখে, ওর মায়ের ও বোনের কথা ভেবে হেলপারির কাজে যোগ দেয়। কিন্তু বাসে আগুন লেগে ও মারা গেল। শাহাবীর মরার পর বাস কোম্পানির এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাত্র ৫৫ হাজার টাকা দিয়েছে বাকি টাকা দেয়নি। বাকিটা দিলে আমাদের ভালো হতো।
নানি আয়েশা বেগম বলেন, আমার তিন ছেলে রাশেদ, রুবেল ও রানা। বড় দুই ছেলে অটো চালায়, ছোট ছেলে ঢাকায় ফেরি করে। গরিব মানুষ আমরা। মেয়ে মুন্নীকে বিয়ে দিয়েছিলাম। আগে স্বামীটা ভালোই ছিল। পরে নেশা করতে শুরু করল। মেয়েটারে মারত, নাতি-নাতিনরেও মারত। পরে মেয়েটা আমার বাসায় চলে আসে। নাতিটা বোনেরে পরাইবো বলে বাসে কাম নিল। বাসেই পুইড়া মরল।
শাহাবীরের বোন সোহানা বলেন, আমার বাবার চেহারা আমার মনে নেই। বাবাকে দেখলেও এখন চিনব না। সে আমাদের খোঁজ-খবর নেয় না। ভাইটার সঙ্গে খেলা করতে করতে বড় হয়েছি। ভাই আমাদের সুখের জন্য চাকরি করতে গিয়ে মইরা গেল। এখন আমার মা ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই।
স্থানীয় আলেয়া ইসলাম বলেন, মুন্নী আমার ভাতিজি হয়। ওরে টাকা পয়সা বাস মালিকের দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেয় নাই।
শাহাবীরের খালা মমতাজ বেগম বলেন, শাহাবীরকে আমরা বাসে হেলপারি করতে নিষেধ করতাম। কিন্তু ও বলতো ওর বোনকে কলেজে পড়াতে হবে। তাই নিজে চাকরি ঠিক করে বাসের হেলপারি করতে গেল। বাসের মধ্যেই আগুন লেগে মারা গেল ছেলেটা।
বাস মালিক ও চালক আজিজ বলেন, শাহাবীর আমার সঙ্গেই বাস চালাতো। আমার বাস নষ্ট হওয়ায় মেরামতের জন্য দিলে আমি শাহবীরকে বলি, আমার বাস ঠিক হোক তুমি কয়দিন বাড়িতে থেকে এসো। কিন্তু শাহাবীর বলেছিল, আমি বাড়িতে থাকলে সংসার চলব কীভাবে। তাই আমাদের আরেক চালক কাউসারের সঙ্গে বাসে কাজ ঠিক করে দেই। গত ১২ ফেব্রুয়ারি কাউসারের বাসে আগুন লেগে শাহাবীর মারা যায়। ওর পরিবারকে ১ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল পরিবহন মালিকদের। আমি অনেক চেষ্টা করে ৫৫ হাজার টাকা নিয়ে দিয়েছি, এখনও ৪৫ হাজার টাকা বাকি আছে।
মা মুন্নী বেগম বলেন, শাহাবীরকে প্রথমে মাদরাসায় ভর্তি করালাম। কিন্তু ও লেখাপড়া করল না। আমার অভাব অনটন দেখে নিজেই প্রথমে লেগুনা পরে বাসের হেলপারি শুরু করল। বাসেই পুড়ে মারা গেল। বাসের লোকজন আমাদের খবর দিল। গিয়ে দেখি আমার ছেলে আগুনে এমনভাবে পুড়ছে যে ওর চেহারা চেনা যায় না। বাসের মালিক পক্ষ বলছিল, তোমরা কোনো অভিযোগ দিও না। আমরা তোমাদের এক লাখ টাকা দেব। কিন্তু ৮ মাস হলেও এখন আমাদের টাকা পুরোটা দিল না।
স্থানীয় গাওদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ৯নং ইউপি সদস্য শাহ আলম বলেন, শাহবীর মারা যাওয়ার পরে কিছু টাকা পরিবহন মালিক কর্তৃপক্ষের ওর পরিবারকে দেওয়ার কথা ছিল। এখনো সম্পন্ন টাকা দেয়নি। আমি নিজেও পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করছি। তারা দেবে
বলে ঘুরাইতেছে।
অভিযুক্ত বাস মালিক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার বাসে পুড়ে ছেলেটি মারা যাওয়ার পরে মালিক সমিতি আমার পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার্য্য করে। আর বাকি টাকা মালিক সমিতি দেবে বলে। আমি আমার টাকা দিয়ে দিয়েছি। বাকি টাকা মালিক সমিতির দেওয়ার কথা। তারা টাকা দেয়নি।
এদিকে একাধিক বাস মালিক ও বাস ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর হতে মুন্সীগঞ্জ জেলায় কোন বাস মালিক পরিবহন সমিতি নেই।
গাংচিল পরিবহনের সার্বিক দায়িত্বে থাকা আলী মোহাম্মদ বলেন, শাহাবীরের মৃত্যুর পরে আমাদের গাংচিল পরিবহন ভেঙে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যার কারণে ঝামেলা হওয়ায় আমরা সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। থানায় বইসা একটা মিমাংসা হয়েছিল। ১ লাখ টাকা মৃত হেলপারের পরিবারকে দেওয়ার কথা ছিল। বিষয়টি আমরা দ্রুত মিমাংসা করে ফেলব।
টঙ্গিবাড়ী ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার অতিকুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছিলাম। বাসের ভেতর থেকে শাহাবীর নামের এক কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহটি আগুনে পুড়ে একেবারে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, বাসের ভেতরে মশার কয়েল জ্বালানোয় কয়েল হতে আগুনের সূত্রপাত হয়।
টঙ্গিবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল আলম বলেন, ঘটনার সময় আমি এই থানায় ছিলাম না। ঘটনার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। যদি কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ করে তবে খতিয়ে দেখব।
বেতকা পরিবহনের বাসের মালিক নুর হোসেন সর্দার বলেন, বর্তমানে আমাদের কোনো পরিবহন সমিতি নেই। বাসের ব্যবসা মুন্সীগঞ্জে ভালো না। রাস্তায় লাইসেন্সবিহীন অটোরিকশার ছড়াছড়ি। আমাদের জেলার ভেতরে কোনো বাস যাত্রী নিয়ে চলাচল করে না। এ জেলা হতে কিছু বাস ঢাকায় যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। আমাদের বাসের অবস্থা দিন দিনই খারাপ হচ্ছে।
ব.ম শামীম/আরকে