লোকসান গুনছেন পেঁয়াজ চাষিরা

অনুকূল আবহাওয়ায় মানিকগঞ্জে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। পেঁয়াজের ফলন ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। গত কয়েক মৌসুমে পেঁয়াজের বাজারদর ভালো পেলেও চলতি মৌসুমে উৎপাদন খরচ তুলতে বিপাকে পড়েছেন জেলার কয়েক হাজার পেঁয়াজ চাষি।
জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পেঁয়াজ চাষাবাদের জন্য জমি তৈরি, বীজ (গুটি পেঁয়াজ), সার, কীটনাশক, পানি ও শ্রমিকের মজুরি নিয়ে প্রতি বিঘায় খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। খেত থেকে পেঁয়াজ তুলে বাজারজাতকরণে খরচ হবে আরও ৯ হাজার টাকা। আর বিঘা প্রতি পেঁয়াজের ফলন হয় ৫০ মণ।
পেঁয়াজের হালনাগাদ বাজারদর প্রতি মণ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। সে হিসেবে ৫০ মণ পেঁয়াজের বাজারদর আসে ৪০ হাজার টাকা। এ কারণে চলতি মৌসুমে লাভের আশা ছেড়ে দিয়ে উৎপাদন খরচ তুলতেই হিমশিম অবস্থা বলে মন্তব্য করেন কৃষকরা।
মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় , গত মৌসুমে মানিকগঞ্জে ৫ হাজার ৬৪৩ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছিল। বাজারদর ভালো আর বাম্পার ফলনের কারণে চলতি মৌসুমে পেঁয়াজ চাষির সংখ্যাও বেড়েছে বলে ধারণা কর্তৃপক্ষের।
জেলায় এ বছর পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৪ হেক্টর জমি। প্রতি হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৬০ টন। জেলায় মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ লাখ ৭৫ হাজার ২৮২ টন।
তবে এখনও অনেক কৃষক হালি পেঁয়াজ বপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরইমধ্যে বাজারে আগাম চাষাবাদ করা পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে। চাহিদানুযায়ী বাজারদর না পাওয়ায় হতাশ আগাম পেঁয়াজ চাষিরা। সংসারের চাহিদা মেটাতে অনেক কৃষক বাজারে নতুন পেঁয়াজ বিক্রি করলেও ভালো বাজারদরের প্রত্যাশায় নিজ বাড়িতে পেঁয়াজ সংরক্ষণে রাখছেন অনেকেই।
হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার পেঁয়াজ চাষি কৃষক আব্দুর রাজ্জাক (৫৫) বলেন, চলতি মৌসুমে ৩৩ শতক জমিতে সাগা (গুটি) পেঁয়াজের আবাদ করেছেন তিনি। হাল চাষ, গুটি পেঁয়াজ, সার, ভিটামিন, পানি ও শ্রমিকের মজুরিসহ সব মিলে খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। তবে চলতি মৌসুমে পেঁয়াজের ফলনও ভালো হয়েছে। যে কারণে জমি থেকে ৫০ মণ পেঁয়াজ পাবেন তিনি।
কিন্ত পেঁয়াজের বর্তমান বাজারদর ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এই টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করলে নতুন করে শ্রমিকের খরচ ও বাজারজাতকরণের ব্যয় বহন শেষে লাভে খাতা শূন্য বলে জানান তিনি।
শিবালয় উপজেলার নবগ্রাম এলাকার কৃষক সরুজ আলী বলেন, পেঁয়াজের ফলন ভালো হলে কী হবে? বাজারদর তো মন্দা। পরিবারের চাহিদা মেটাতে লোকসানেই বিক্রি করছি পেঁয়াজ। তার মতো অনেক কৃষকই লোকসানে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। বাজারে ৮০০ টাকা মণে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণে আগাম পেঁয়াজ চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
বাল্লা এলাকার কৃষানি ডালিমা বেগম (৪০) বলেন, ‘গতবার পেয়াঁজ আবাদে ভালোই লাভবান হয়েছিলাম। যে কারণে চলতি মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছি। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। ফলন তো ভালা হইছে, তয় বাজারে পেঁয়াজের দাম কম। কী করমু? লোকসানে বিক্রি করতাছি। সংসার তো চালাইতে হইবো।’
একই এলাকার কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী একামনি (১৫) বলেন, করোনার কারণে কলেজ বন্ধ থাকায় লেখাপড়ার তেমন চাপ নেই। এ জন্য বাবা-মায়ের কাজে সহযোগিতা করার জন্য পেঁয়াজ খেতে কাজ করছি। সকাল থেকেই পেঁয়াজ তুলছি আর রোদে শুকাচ্ছি। নিজেদের জমিতে কাজ করতে বেশ ভালো লাগছে।
বাল্লা ইউনিয়নের গৃহবধূ রাহিমা (৫০) বলেন, ‘নিজেদের তো জমি-জমা নাই, তাই ভাতিজার জমির পেঁয়াজ উঠানোসহ কেটে দিচ্ছি। তাতে কিছু টাকাও দিবো আর খাওনের পেঁয়াজও দিবো।’
বরংগাইল পাইকারি পেঁয়াজ বাজারের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) পাইকারি বাজারে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মণে পেঁয়াজ বেচাকেনা হয়েছে। তবে বর্তমানে পেঁয়াজের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বাজারদর কমে গেছে।
এ বছর জেলায় ৫ হাজার ৯৫৪ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ লাখ ৭৫ হাজার ২৮২ টন।
শাহ্জাহান আলী বিশ্বাস, উপপরিচালক, মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
তিনি আরও বলেন, অনুকূল আবহাওয়ায় মানিকগঞ্জে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে কৃষি অফিসের লোকজন নিয়মিত পেঁয়াজ চাষিদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তবে বর্তমান পেঁয়াজের বাজারদর নেমে গেছে। এভাবে বাজারদর থাকলে আগাম পেঁয়াজ চাষিদের লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমএসআর