জীবনসংসারে যুদ্ধ শেষ হয়নি বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপের

অভাব আর ঋণগ্রস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার দে (৮২) এখনো জীবনসংসারে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। অভাবের সংসারে অন্য জোগাতে তিনি এখনো গান করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে বৃদ্ধ এই বয়সে শরীর আর আগের মতো চলে না। বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। অভাব-অনটনের কারণে উন্নত চিকিৎসাও করাতে পারছেন না তিনি।
বলছিলাম টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বাংড়া ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের বাগুটিয়া উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত সেতাব কুমার দের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার দের কথা। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে গ্রামের বাড়ি হলেও যুদ্ধের পর চলে আসেন তার শ্বশুরবাড়ি বাগুটিয়ায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাগুটিয়া উত্তরপাড়া এলাকায় শশুরবাড়ির ৫ শতাংশ জমিতে দুই ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিদের নিয়ে বসবাস করছেন। চার বছর আগে সরকার তার ওই জায়গায় পাকা ঘর বীর নিবাস তৈরি করে দিয়েছে। তিন রুমবিশিষ্ট ঘরটিতে বসবাস করছেন তিনি। তবে বয়সের ভারে এখন আর আগের মতো গান গেয়ে টাকা উপার্জন করতে পারেন না।
জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার দের স্ত্রী মালতি রানী দে বছর দুই হলো ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার চন্দন কুমার দে (৩৮) ও রঞ্জন কুমার দে (৩৬) নামের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। মেয়ে দুটিকে সুদে টাকা নিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই ছেলের ঘরে চারজন সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে অন্যের সিএনজি ভাড়া করে চালান। ছোট ছেলে একটি সেলুনে চুল কাটার কাজ করেন।
তবে দুজনের উপার্জনে সংসার চলে না। দিলীপের নিজস্ব কোনো জায়গা-জমি নেই। শ্বশুরবাড়ির ৫ শতাংশ জায়গা পেয়ে সেখানে বসবাস করছে ছেলে সন্তানদের নিয়ে।
বাগুটিয়া উত্তরপাড়া গ্রামের অনেকেই বলেন, তার বাবা মারা যাওয়ার পর তার চার বোনকে লালন-পালন ও বিয়ে দেওয়াসহ সবকিছুই তাকে করতে হয়েছে। এ ছাড়া তার দুটি মেয়েকে বিয়ে দিতে হয়েছে। এতে তিনি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। যে ভাতা পান, তাতে তার সংসার চলে না। তাই এই বয়সে এসেও তাকে কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে টাকা উপার্জন করতে হচ্ছে। এ ছাড়া তার দুই ছেলেও যে কাজ উপার্জন করছেন, তা দিয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় হয় না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপের ছোট ছেলের বউ চন্দনা রানী দে বলেন, বাবার মতোই শ্বশুরকে দেখাশোনা করি। তার সেবা-যত্ন থেকে শুরু সব কাজই করি।

দিলীপের ছোট ছেলে রঞ্জন কুমার দে বলেন, অন্যের সেলুনে কাজ করে যে টাকা পাই, তাতে সন্তানদের লেখাপড়া খরচের টাকাই ওঠে না। এরপর সংসারে খরচ করার মতো টাকা থাকে না। বাবাও আগের মতো কাজ করতে পারেন না। বয়স হওয়ায় বিভিন্ন রোধ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসাও করতে পারছি না। সরকার ও সবার সহযোগিতায় যদি নিজস্ব কোনো দোকান বা ব্যবসা করতে পারতাম, তাহলে হয়তো সংসার ভালোভাবে চলত। বাবাকেও চিকিৎসা করাতে পারতাম।
দিলীপ কুমার দে ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাকিস্তানিরা যখন গণহারে মানুষ হত্যা শুরু করেছে, তখন সেটা দেখে আর ঠিক থাকতে পারলাম না। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধ যাবার। তখন মনে হলো দেশ স্বাধীন না করলে উপায় নেই। আমি একা যুদ্ধ করে মরে যদি আরও দশজন মানুষের জীবন বাঁচে এবং দেশ স্বাধীন হয়, এ জন্য যুদ্ধে যাই।
পরে একদিন রাতে বের হয়ে পরি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। যাওয়ার পর জামালপুরের ধানুয়া কামালপুর, নেত্রকোনা, মদনে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে কর্নেল আবু তাহেরের পায়ে গুলি লেগে পঙ্গু হয়ে যায় এবং ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মারা যান। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে এসে অভাব-অনটনে পড়ে যাই। সে সময় মানুষের কামলা দিয়েছি। অন্যের গাছ কেটে খরি বানিয়ে ও বাঁশের মোতা কেটে দিয়েছি। বাবা মারা যাওয়ায় বোনদের দেখাশোনা ও বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। ঋণ করে বোনদের বিয়ে দিয়েছি। আমারও দুটি মেয়ে ছিল তাদেরও বিয়ে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, বোন ও মেয়েদের বিয়ে দিতে লাখ লাখ টাকা সুদে নিয়ে ঋণে পড়ে যাই। ফলে বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ফান্ড থেকে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকার ঋণ নিয়ে ধারদেনা শোধ করি। এতে ভাতার টাকার থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার ৪১০ টাকা কেটে নেয়। যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে না। বর্তমানে শারীরিক অবস্থা ভালো না। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেও জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি এখনও।
কালিহাতী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, শুনেছি তিনি অসচ্ছল। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সরকারি ভাতা পান। এ ছাড়া তাকে বীর নিবাস করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোবাশ্বের আলম বলেন, ওই মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে তাকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
অভিজিৎ ঘোষ/এনএ