‘মা আমি ভর্তি হতে পারছি, সৃষ্টিকর্তা তোমার কথা শুনেছে’

নরসুন্দরের (নাপিত) ছেলে নিপুণ বিশ্বাস। স্বপ্ন ছিল প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আর্থিক অনটনের শত বাধা পেরিয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (যবিপ্রবি) বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পান তিনি। মেধাতালিকায় প্রথম থেকেও যথাসময়ে উপস্থিত হতে না পারায় যবিপ্রবিতে ভর্তি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল তার।
নিপুণের বিষয়টি উপাচার্যকে জানালে মানবিক দিক বিবেচনায় এক আসন বাড়িয়ে তাকে ভর্তির সুযোগ করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটির আহ্বায়ক ড. মো. মেহেদী হাসান সই করা নোটিশে ভর্তি নিশ্চিতের বিষয়টি যখন নিপুণ জানতে পারেন তখনই খুশিতে কেঁদে ফেলেন। বুধবার নিপুণ যবিপ্রবির স্বাস্থ্য বিজ্ঞান অনুষদের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবেন।
নিপুণ বিশ্বাসের বাড়ি নীলফামারীর সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপে। তার বাবা প্রেমানন্দ বিশ্বাস পেশায় নরসুন্দর (নাপিত)। মা দীপালী বিশ্বাস গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় নিপুণ। ছোটবেলা থেকে আর্থিক অনটনের শত বাধা পেরিয়ে নীলফামারীর মশিয়ুর রহমান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন মেধাবী নিপুণ। আর ছোট ভাই এবার স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
যবিপ্রবির স্বাস্থ্য বিজ্ঞান অনুষদের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে মাকে ফোন দিয়ে নিপুণ বলেন, ‘মা আমি ভর্তি হতে পারছি। সৃষ্টিকর্তা তোমার কথা শুনেছে। আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে।’ সেলফোনের অপর প্রান্তে মা দীপালী বিশ্বাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন ‘বেঁচে থাকো বাবা। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক। তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে। ভর্তি শেষে করেই বাড়ি চলে আসো।’
রাতে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকসহ যশোরের গণমাধ্যম কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে নিপুণ বলেন, সাংবাদিকরা যদি আমার এই বিষয় নিয়ে লেখালেখি না করতেন তাহলে মনে হয় যবিপ্রবি ভিসি স্যারের নজরে আসত না।
তাই তিনি গণমাধ্যমকর্মী ও তার সম্পর্কে নিয়মিত যারা খোঁজ খবর নিয়েছেন তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবেন বলে জানান।

তিনি আরও বলেন, দুই দিন ধরে আমার ঘুম হয়নি। ক্যাম্পাসের বাইরে একটি বড়ভাইয়ের মেসে আজ রাত কাটাব। বুধবার সকাল ১০টায় আমাকে ভর্তি করবে যবিপ্রবি প্রশাসন। ভর্তি হতে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা লাগবে। কিন্তু আমার কাছে আছে ৬ হাজার টাকা। ভর্তির টাকা কমাবে কি না বুঝতে পারছি না, তবে যেটুকু শুনেছি ভর্তির যা টাকা সেই টাকা দিয়েই বিভাগে ভর্তি হতে হবে। সকালে গিয়ে দেখি, বিভাগীয় চেয়ারম্যান স্যার কিছু ভর্তি ফি মওকুফ করেন কি না! সকালে ভর্তি হয়েই মা-বাবার কাছে যাব। তারাও দুই দিন ধরে অনেক চিন্তায় আছেন।
নিপুণের বাবা প্রেমানন্দ বিশ্বাস বলেন, যবিপ্রবির ভিসি স্যারকে ধন্যবাদ। আমাদের মতো গরিবের জন্য মানবিক দৃষ্টি দেওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। কলেজ প্রশাসন না ছেলের ভুলে এমন কাজ হয়েছে সেটা আর মনে রাখতে চাই না। মানবিক দিক থেকে কলেজ প্রশাসন আমার ছেলের ভর্তি করেছে। সেই কারণে সকল স্যারদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে হতদরিদ্র বাপের সংসারের হাল ধরবে এমনটাই প্রত্যাশা তার।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. মো. তানভীর ইসলাম বলেন, নিপুণ বিশ্বাসের বিষয়টি উপাচার্যকে জানালে তিনি মানবিক দিক বিবেচনায় শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে একটি আসন বাড়িয়ে তাকে ভর্তি করার জন্য ডিনস কমিটিকে অনুরোধ করেন। উপাচার্যের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে একটি আসন বাড়িয়ে নিপুণকে ভর্তি করানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ডিনস কমিটি। বুধবার সকাল ১০টায় তার ভর্তির যাবতীয় কার্যাবলী শেষ করা হবে।
এদিকে যশোরে অসহায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আহ্বান’ প্রথম বর্ষের বই কিনে দেওয়াসহ ও আগামী মাস থেকেই একটি টিউশনির ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খান জাহান আলী শান্ত বলেন, নিপুণকে নিয়ে ঢাকা পোস্ট নিউজ করলে আমার নজরে আসে। নিউজটা পড়ে অনেক মন খারাপ হয়েছিল। যবিপ্রবিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে নিপুণ যেমন খুব খুশি, আমরাও খুশি। রাতে নিপুণের সঙ্গে কথা বলেছি। আহ্বান যশোরের পক্ষ থেকে তাকে প্রথম বর্ষের বই কিনে দেওয়ার পাশাপাশি আগামী মাস থেকেই একটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টে ‘পথের দূরত্বে সোনার হরিণ হারিয়ে ফেললেন নিপুণ’ ও ‘কেউ ভর্তি বাতিল করলেই ভর্তি হতে পারবেন নিপুণ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপরই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
জাহিদ হাসান/এসকেডি