টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের, কপাল পুড়েছে অনেকের

‘সত্যের সাথে সন্ধি’— স্লোগান নিয়ে ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট। পেশাদারিত্ব ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে প্রাধান্য দেওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে পাঠকের মনে আস্থার জায়গা তৈরি করে নেয় অনলাইন গণমাধ্যমটি।
একের পর এক ব্রেকিং নিউজ আর বিশেষ প্রতিবেদন আলোড়ন সৃষ্টি করে সব মহলে। দুর্নীতি, অনিয়ম কিংবা জনসেবা খাতের প্রতিবেদনে ব্যাপক সাড়া ফেলে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনের আলোকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়। গত চার বছরে ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদনের কারণে কেউ হয়েছেন বদলি, কাউকে দেওয়া হয়েছে অব্যাহতি। ডিমোশন হওয়ার পাশাপাশি পদ হারানোর নজিরও রয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা পোস্টের উপ-প্রধান প্রতিবেদক শফিকুল ইসলামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন “ঋণের টাকা দিতে ‘অক্ষম’ প্রতিষ্ঠানকে আবারও ঋণ দিলো ইসলামী ব্যাংক” সংশ্লিষ্ট আর্থিক খাতে বেশ সাড়া ফেলে। টনক নড়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। দ্রুত ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ এবং নিজ জামাতাকে (মেয়ের স্বামী) ইসলামী ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও নির্বাহী কমিটির (ইসি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে। অভিযোগের সত্যতা মেলায় গত ৬ জানুয়ারি নির্বাহী কমিটির (ইসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে আব্দুল জলিলকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবার নিয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রথম পর্বের শিরোনাম ছিল ‘১৭ একর জমিতে ১১ গ্যাং, মাদক কারবারি দেড় হাজার’। পরের দিন অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় পর্ব ‘থানা লুটের অস্ত্রে নিয়ন্ত্রণ মাদকের কারবার!’। ৩০ সেপ্টেম্বর ‘পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে’ প্রতিবেদন পেয়েও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ— শিরোনামে শেষ পর্বটি প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন তিনটি প্রকাশিত হওয়ার পর জেনেভা ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে যৌথ বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় একাধিক মাদককারবারি ও অস্ত্রব্যবসায়ীকে।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সেলিম আশরাফি ওরফে চুয়া সেলিম ও কসাই সোহেল। চুয়া সেলিম হত্যা, লুট, অস্ত্র ও মাদকসহ অন্তত এক ডজন মামলার আসামি। অন্যদিকে, কসাই সোহেল জেনেভা ক্যাম্পে বোমা তৈরির অন্যতম কারিগর এবং হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া প্রতিবেদক আরাফাত জোবায়ের। গত ২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিটি পর্বে সংস্থাটির বিভিন্ন বিষয়ের দুর্বলতা ও অসংগতি তুলে ধরা হয়। যা ক্রীড়াঙ্গনে গতিশীলতার অন্তরায় ও উন্নতির প্রতিবন্ধক। এনএসসি ঢাকা পোস্টের সেসব প্রতিবেদন আমলে নিয়ে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে।
৩০ জানুয়ারি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব আমিনুল ইসলাম, এনডিসি স্বাক্ষরিত চিঠিতে পাঁচ সদস্যের কমিটিকে ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কোন কোন বিষয় এনএসসি গ্রহণ করতে পারে এবং সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব, তা নিয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালককে (ক্রীড়া) কমিটির আহ্বায়ক, ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালককে সদস্য সচিব, সহকারী পরিচালককে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এবং হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষক কামরুল ইসলামকে (কিরণ) কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়। এ ছাড়া একটি সমন্বিত কমিটি গঠিত হয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সব শাখার প্রতিনিধিদের নিয়ে।
ঢাকা পোস্ট ক্রীড়াঙ্গনের নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতির বিষয় নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরে। সংবাদমাধ্যমটি ২০২৩ সালে জাতীয় পরিষদের স্বীকৃত ‘ক্রীড়া সঙ্গীত’ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্বের অনেক দেশে ক্রীড়া সঙ্গীত নেই, অথচ বাংলাদেশে থাকলেও সেটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব। ঢাকা পোস্টের বিশেষ এ প্রতিবেদন এআইপিএস (ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন) মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড, ২০২৪ এর এশিয়া মহাদেশের মধ্যে শীর্ষ দশে স্থান করে নেয়। এ ছাড়া ২০২২ সালে ঢাকা পোস্ট ‘মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ৫০ বছর’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কোচ ও খেলোয়াড় সংকটসহ নানা অসংগতি তুলে ধরা হয়। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় ‘লিঙ্গের ভিত্তিতে ক্রীড়া সংস্থা’, যা বিশ্বে খুবই বিরল। চার পর্বের ধারাবাহিক ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এআইপিএস মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০২৩, এর একটি ক্যাটাগরিতে এশিয়ার প্রথম স্থান অর্জন করে।
ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তানভীরুল ইসলাম। দেশের স্বাস্থ্য খাতের খুঁটিনাটি যাবতীয় বিষয় যেন তার নখদর্পণে। গত ১০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদ ডা. রোবেদ আমিনকে নিয়ে “অনিয়ম-দুর্নীতি আর ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা নিয়েও তিনি শীর্ষ কর্তা!” শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তিনি। প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডা. রোবেদ আমিনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদ সরিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত ২০ জুন বিএসএমএমইউ নিয়ে “সাবেক ভিসির অনিয়মে ‘অকাজের কাজি’ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল” শিরোনামে আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী আহসানুল হক দীপ্তর অবহেলাজনিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের মারধরের অভিযোগে ওঠে। দোষীদের শনাক্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন চিকিৎসকরা। গত ১ সেপ্টেম্বর সেই আন্দোলন নিয়ে “চিকিৎসকদের ওপর হামলা : নীরবে ‘অন্য খেলায়’ নেমেছেন স্বাচিপপন্থিরা” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তানভীরুল ইসলামের ওই প্রতিবেদনের কারণে পরে চিকিৎসকদের আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক সচিবালয়ের আউটসোর্সিং কর্মীদের নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর “আউটসোর্সিং কর্মীদের বেতনে ফুলছে ‘ঠিকাদারের পেট’’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করেন। ওই প্রতিবেদনের পরের দিনই গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাকিলা জেরিনকে সরিয়ে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয় অতিরিক্ত সচিব (মনিটরিং) কামাল উদ্দীনকে। এ ছাড়া কিছু আউটসোর্সিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতনও বাড়িয়ে দেয়।
ঢাকা পোস্টের ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধি সৈয়দ আমানত আলী। গত বছরের ১৩ অক্টোবর “ঢাকা মেডিকেলে ওয়ার্ড মাস্টার বানানোর হিড়িক!” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করেন তিনি। সেই প্রতিবেদনে বক্তব্য দেওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মুহাম্মদ নুরুল ইসলামকে অন্যত্র বদলি করা হয়।
প্রকাশিত সংবাদে তিনি ঢাকা মেডিকেলে ওয়ার্ড মাস্টার নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে বক্তব্য দেন। ডা. মুহাম্মদ নুরুল ইসলামকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপ-পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়। তার জায়গায় হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (অর্থ ও স্টোর) ডা. মুহাম্মদ আশরাফুল আলমকে পদায়ন করা হয়।
এমএসআই/