অব্যবস্থাপনা ও সেবার মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়লেও হাসপাতালটির সেবার মান নিয়ে রোগী ও স্বজনদের অভিযোগের শেষ নেই। পর্যাপ্ত মশারির মজুত থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ রোগী বলছেন, তারা মশারি পাচ্ছেন না। এমনকি অনেকের ভাগ্যে বেডশিটও জোটেনি।
গতকাল সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন রোগীকে মশারি দেওয়া হলেও কোনো বেডেই তা টানানো নেই। ওয়ার্ডজুড়ে মশার উৎপাত, ভিড় আর গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। রোগীরা অভিযোগ করেন, বারবার চাইলেও তাদের মশারি দেওয়া হয়নি। কারও কারও অভিযোগ, মশারি না পেলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে মশার কয়েল কিনে ব্যবহার করছেন।

হাসপাতালের পরিবেশ এবং অব্যবস্থাপনা
হাসপাতালের ওয়ার্ডে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে স্যাঁতসেঁতে মেঝে আর নাকে আসে জমে থাকা বর্জ্যের গন্ধ। বেডগুলোতে নতুন রোগীর চাপ, পাশে স্বজনদের ভিড়ে হাঁটাচলা করাও কঠিন। নার্সিং স্টেশনে রোগী নিয়ে গেলে ব্লাড স্যাম্পল পরীক্ষার মতো জরুরি সেবা মিলছে না বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।
প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ওয়ার্ড সংলগ্ন এলাকায় জমে আছে নোংরা পানি ও আবর্জনা। কোথাও কোথাও হাঁটুসমান পানি জমে মশার উৎপাত বেড়েছে কয়েক গুণ। সেই নোংরা পানিতে ভাসছে খাবারের প্যাকেট, ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা রকম বর্জ্য
হাসপাতালের চারপাশ ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ওয়ার্ড সংলগ্ন এলাকায় জমে আছে নোংরা পানি ও আবর্জনা। কোথাও কোথাও হাঁটুসমান পানি জমে মশার উৎপাত বেড়েছে কয়েক গুণ। সেই নোংরা পানিতে ভাসছে খাবারের প্যাকেট, ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা রকম বর্জ্য।
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের ভেতরে যেমন সেবা নেই, বাইরের পরিবেশ তেমনই নাজুক। হাসপাতাল এলাকায় মশার প্রজননের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হওয়ায় ডেঙ্গুর ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
আরও পড়ুন
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (সকাল ৮টা পর্যন্ত) নতুন করে ২৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৭ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে এক হাজার ৯১১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন সাতজন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ
খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া থেকে সন্তানকে নিয়ে আসা মেরাজ নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘আজ তিন দিন হয়ে গেল আমাদের মশারি দেওয়া হয়নি। একটি বেডশিটও পাইনি। কিছু চাইতে গেলে বলে আমরা জানি না কিংবা নেই। এমন অবহেলা একেবারেই অমানবিক।’
ধোলাইপাড় থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে আসা আব্দুল্লাহ মিয়া বলেন, ‘আমরা কয়েক দিন হলো ভর্তি আছি। অথচ এখনও মশারি দেয়নি। প্রতিদিন মশার কামড়ে বাচ্চার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। বাইরে থেকে কয়েল কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে।’
মুগদার দক্ষিণপাড়া থেকে আসা আরেক রোগী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মশারি চাইলে ওয়ার্ড বয় বলে স্টোরে নেই। অথচ দেখি ভেতরে মশারি রাখা আছে। নার্সদের আচরণও খারাপ। আমরা রোগী হয়ে এসেছি, ভিক্ষুক না যে বারবার অপমান সহ্য করব।’
তিনিও বলেন, ‘রাতে মশারির জন্য নার্সিং স্টেশনে গিয়েছিলাম। তারা বলল, এখন দেওয়া সম্ভব নয়। সারারাত মশার কামড়ে ঘুমাতে পারিনি। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য যেখানে মশারি সবচেয়ে জরুরি, সেখানে এর অভাবটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।’

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
এ বিষয়ে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে পর্যাপ্ত মশারিসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের সরবরাহ রয়েছে। তবুও কেন অনেকে পাচ্ছেন না, সেটা আমরা খতিয়ে দেখব। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক করা হবে।’
‘নার্সদের বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তাদের আচরণ ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে সতর্ক করা হবে। কিছু সমস্যার সত্যতা আছে, আমরা দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করব।’
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মুস্তাফিজুর রহমানের দপ্তরে গেলে বলা হয়, পরিচালক ডেঙ্গু নিয়ে কথা বলেন না। পরে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে চাইলে জানানো হয়, পরিচালক স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে জুম মিটিংয়ে আছেন। অপরদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, উপদেষ্টা সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে আজ আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন
ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ইনচার্জ নার্গিস আক্তার বলেন, ‘আমরা প্রতিটি বেডেই মশারি দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক রোগী মশারি নিতে চান না। তবে, নতুন করে আবার খোঁজ নেওয়া হবে।’
নার্সিং সুপারভাইজার সাবিনা ইয়াসমিন অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, ‘মশারি থাকার পরও যদি রোগীরা না পান, সেটা বড় ভুল। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। নার্সদের খারাপ আচরণ নিয়েও খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পরিচালক যেন ‘অমাবস্যার চাঁদ’
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মুস্তাফিজুর রহমানের দপ্তরে গেলে বলা হয়, পরিচালক ডেঙ্গু নিয়ে কথা বলেন না। পরে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে চাইলে জানানো হয়, পরিচালক স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে জুম মিটিংয়ে আছেন। অপরদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, উপদেষ্টা সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে আজ আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। তিনি লম্বা সময় প্লেনে থাকবেন, সুতরাং এ ধরনের কোনো জুম মিটিং নেই। সর্বশেষ পরিচালকের ফোন নম্বর চাইলে সেটাও দেওয়া নিষেধ বলে জানান তার ব্যক্তিগত সহকারী।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘মশারি সরবরাহ নিয়ে ত্রুটি থাকলে অবশ্যই তাদের সতর্ক করব। যেহেতু আমাদের পর্যাপ্ত মশারি রয়েছে, সেহেতু রোগীদের দিতে সমস্যা নেই।’
ভুল তথ্য দিয়ে হাসপাতাল পরিচালকের কথা না বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। তাকে হাজারটা প্রশ্ন করলেও তিনি উত্তর দেবেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব যদি উত্তর দেন তাহলে তাদের উত্তর দিতে বাধা কোথায়? বিষয়টা আমরা জানলাম, অবশ্যই এ বিষয়ে আমরা কাজ করব।’

আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারেক এম হোসেন এই পরিস্থিতিকে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতী রোগ নিয়ন্ত্রণে মশারি হলো প্রাথমিক ও কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অথচ রাজধানীর একটি শীর্ষ সরকারি হাসপাতালে রোগীরা মশারি পাচ্ছেন না— এটি শুধু দুঃখজনক নয়, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতার স্পষ্ট প্রমাণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে রোগীরা আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন, কারণ হাসপাতালের ভেতরেই নতুন করে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।’
ডা. হোসেন আরও বলেন, ‘অভিযোগ শুধু মশারি না পাওয়া নয়, রোগীরা বেডশিট পাচ্ছেন না, নার্সদের সেবা পেতে গেলে হয়রান হতে হচ্ছে— সবমিলিয়ে এটি আসলে একটি সংকটাপন্ন জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি। একটি হাসপাতাল, যেখানে নিরাপদ চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা, সেখানে রোগী ও স্বজনদেরকে বাজার থেকে কয়েল কিনে মশা তাড়াতে হচ্ছে— এটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য মানদণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এমন চিত্র রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।’
এমএম/এসএসএইচ
