৫০০ টাকায় ৮৮ লাখ শেয়ার, শ্বশুরের প্রভাব দেখালেন পুত্রবধূ!

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের ছোটখাটো ভুলের জন্য কমিশন, চার্জ আর নিয়মের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার নজির হরহামেশাই মিলছে। অথচ মাত্র ৫০০ টাকা জমা দেখিয়েও ৮৮ লাখ ইউনিট শেয়ার ক্রয় করা যায়! আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, নিজ নামে ব্যাংক হিসাব না থাকলেও শুধুমাত্র ব্রোকারেজ হাউসের বিও (Beneficiary Owners) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সাড়ে ৩০ কোটি টাকা উত্তোলন ও বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
অবিশ্বাস্য হলেও নুসরাত নাহার নামের এক বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার দ্বৈত নাগরিক এমন কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিও অ্যাকাউন্টে প্রায় ৫০ কোটির বেশি সন্দেহজনক লেনদেনেরও তথ্য রয়েছে। অন্যদিকে, বিপুল পরিমাণ লেনদেন করলেও নুসরাত নাহারের নামে বাংলাদেশে আয়কর নথি নেই। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেন করে ব্যবসা করলেও সরকারকে আয়কর দেননি তিনি।
কোম্পানির বিও হিসাব ব্যবহার করে সরাসরি ৩০.৫৬ কোটি টাকা উত্তোলন করে বিদেশে পাচার, মানিলন্ডারিং ও শেয়ার জালিয়াতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নুসরাত নাহারের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের পুত্রবধূ এবং আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ব্যবসায়ী ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের মেয়ে। তিনি একসময় সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যানও ছিলেন। অর্থাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারে এমন অপকর্ম হয়েছে— এটা পরিষ্কার।
শেয়ারবাজার, ব্যাংক ও দুদক থেকে পাওয়া নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির ক্ষমতার প্রভাব ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে তার পুত্রবধূ নুসরাত নাহারের নামে কোটি কোটি টাকা পাচার, অবৈধ বিনিয়োগ ও সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন।
যদিও বিও হিসাবে এমন অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রোকারেজ হাউস বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি মিথুন দত্ত কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কথা বলতে বাধ্য নই। আমি কোনো জবাব দিতে চাই না।’
অন্যদিকে, দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুদকের চলমান অনুসন্ধানে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন দুদক রেকর্ডপত্র যাচাই করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অনুসন্ধান কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী কমিশনের অনুমতি-সাপেক্ষে এক্ষেত্রেও আইনি পদক্ষেপ নেবে দুদক।’
সন্দেহজনক বিও অ্যাকাউন্ট
এনআরবি ইক্যুয়িটি ম্যানেজমেন্ট নামের ব্রোকারেজ হাউস প্রাইম ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় নুসরাতের বাংলাদেশি পাসপোর্ট (পাসপোর্ট নং-বিএন০০৫৪...) ব্যবহার করে ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে বিও অ্যাকাউন্ট খোলে। বিও হিসাবটিতে আর কখনও অর্থ জমা না করা হলেও লুব রেফ বাংলাদেশ লিমিটেডের ৮৮ লাখ ইউনিট শেয়ার (কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৬.০৬%) হিসাবটিতে জমা হয়। ফেস ভ্যালুতে জমা হওয়া শেয়ারের মূল্য ছিল ৮.৮০ কোটি টাকা। অথচ নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশি হিসেবে তিনি বিদেশ থেকে ওই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে এনেছেন— এমন তথ্যপ্রমাণ মেলেনি বলে জানা গেছে। নুসরাত নাহার অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক (পাসপোর্ট নং-এন৫৪১৬...) এবং সিঙ্গাপুরের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট। তিনি প্রি-আইপিও প্লেসমেন্ট হিসেবে ৮৮ লাখ শেয়ার কিনে থাকলে ওই অর্থ কোনো প্রক্রিয়ায় কোম্পানিকে পরিশোধ করেছেন, সে বিষয়ে কোনো ডকুমেন্ট শেয়ার-সংশ্লিষ্ট কেউ দিতে পারেননি।
অন্যদিকে, বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেডের নামে সাউথইস্ট ব্যাংকে পরিচালিত হিসাব ব্যবহার করে নুসরাত নাহার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। অথচ ওই ব্যাংকে নুসরাতের কোনো ব্যাংক হিসাব নেই, শুধুমাত্র নিজ নামে বিও হিসাব দেখিয়ে কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুদকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব ছাড়া বিও হিসাব খোলার সুযোগ নেই। বিএলআই ক্যাপিটালের সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের হিসাব খোলা সম্ভব নয়।
নুসরাত নাহারের নামে পরিচালিত হিসাবটিতে তার নিজ নামের কোনো ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ জমা করে শেয়ার ক্রয় করা হয়নি। অথচ সাউথইস্ট ব্যাংকের হিসাবটি ব্যবহার করে প্রায় ১৯.৯৫ কোটি টাকার শেয়ার নুসরাতের নামে ক্রয় করা হয়েছে। তাও পে-অর্ডার দিয়ে। ২০১৭ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসের বিভিন্ন সময়ে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে পে-অর্ডার ইস্যু করে শেয়ার ক্রয় করা হয়েছে। পরবর্তীতে পুরো টাকাই উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থ কোন দেশে পাচার হয়েছে তার উৎস খুঁজছেন গোয়েন্দারা।
পে-অর্ডারের যত লেনদেন
২০১৭ সালের ৩ জুলাই নুসরাতের নামে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ৯০ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫০ টাকার পে-অর্ডার ইস্যু করে শেয়ার ক্রয় করা হয়েছে। একই দিন ওই ব্যাংক থেকে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা, ওই বছরের ১৮ জুলাই ৪৬ লাখ, ৩ আগস্ট ২৫ লাখ এবং ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই ৪৫ লাখ টাকা পে-অর্ডার ইস্যু করে শেয়ার ক্রয় করা হয়। একই ব্যাংক নুসরাতের নামে ২০২০ ও ২০২১ সালে জুন, আগস্ট ও ডিসেম্বরে একই প্রক্রিয়ায় প্রায় আট কোটি ৯২ লাখ টাকার পে-অর্ডার ইস্যু করে শেয়ার ক্রয় করা হয়েছে কোনো ব্যাংক হিসাব ছাড়াই।
অন্যদিকে, ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই সিটি ব্যাংক থেকে ১২ লাখ, ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি তিন কোটি ছয় লাখ, ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি একই ব্যাংক থেকে তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি দুই কোটি টাকা নুসরাতের নামে বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের হিসাব থেকে শেয়ার ক্রয় করা হয়েছে। সবমিলিয়ে পে-অর্ডার ও চেকের মাধ্যমে মোট ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকার শেয়ার ক্রয় করা হয়েছে নুসরাত নাহারের নামে।
বিভিন্ন উৎস থেকে ‘বেনামি’ অর্থ নুসরাতের নামে ব্যবহার করা হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। যার মধ্যে মিথ্যা ঋণের গল্পও রয়েছে বলে জানা যায়। পে-অর্ডারের মাধ্যমে ক্রয় করা শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ওই ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকাসহ মোট ৩০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে বিদেশে পাচার হয়েছে বলে প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে।
অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্টরা বলছে, নুসরাত নাহারের নামে পরিচালিত বিও হিসাব থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উক্ত নগদ অর্থ উত্তোলন করেছেন মো. আব্দুল খালেক নামের এক ব্যক্তি। খালেকের নামে সাউথইস্ট ব্যাংক কর্পোরেট শাখায় একটি হিসাব রয়েছে (হিসাব নং-০০৩১১২০০০৮৪...)। বিএসইসি রুলস ২০২০ এর বিধি নং- ৬(১) অনুযায়ী, কোনো গ্রাহকের বিও হিসাবে নগদ জমা করার সুযোগ থাকলেও নগদ অর্থ উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বিধি লঙ্ঘন করে বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেড বিভিন্ন সময়ে প্রায় দুই কোটি টাকা নগদে উত্তোলন করা হয়েছে।
মূলত বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেড ও বিএলআই লিজিং নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সাউথ-ইস্ট ব্যাংক থেকে ঋণ ইস্যু করে ওই টাকা দিয়ে নুসরাত নাহারের নামে শেয়ার ইস্যু দেখিয়ে লুটপাট হয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
সার্বিকভাবে রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ করে আরও দেখা গেছে, নুসরাত নাহারের নামে বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেডের পরিচালিত বিও হিসাবে জমা হওয়া ১৯.৯৫ কোটি টাকা তিনি নিজে প্রদান করেননি। এমনকি উক্ত বিও হিসাবটি থেকে মোট উত্তোলন করা প্রায় ৩০.৫৫ কোটি টাকা কোনো ব্যাংক হিসাবে জমা হয়নি। অর্থাৎ পুরো টাকাই পাচার হয়ে গেছে বলে মনে করছে দুদক।
এ বিষয়ে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নুসরাত নাহারের নামে দুটি বিও অ্যাকাউন্টে ৩০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ প্রবাহিত হয়েছে, যার উৎস অজ্ঞাত। নিজের নামে কোনো ব্যাংক হিসাব না খুলে ব্রোকারেজ বা তৃতীয় পক্ষের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। যেখান থেকে ৮৮ লাখ ইউনিট আইপিও শেয়ার ক্রয় করা হয়েছে। ফেস ভ্যালুতে যার মূল্য ৮.৮০ কোটি টাকা। আর উত্তোলন ও পাচার হওয়া অর্থের অধিকাংশ ভাউচার ব্রোকারেজ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কয়েক বছর ধরে এসব অনিয়ম চললেও ব্রোকারেজ হাউসের অডিটররা বিষয়টি চিহ্নিত করেনি।
তিনি বলেন, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় নুসরাত নাহারের বিও হিসাবগুলো দুর্নীতি, অবৈধ অর্থ লেনদেন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি সুস্পষ্ট কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। অজানা উৎস থেকে শেয়ার ক্রয় এবং ৩০ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন— দুটিই অত্যন্ত গুরুতর আর্থিক অপরাধের আলামত।
আরএম/
