কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রোগীতে ভরে যায় উহানের সব হাসপাতাল, গোপন ভিডিও

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের একেবারে শুরুর দিকে এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে চীন সরকারের ভাবলেশহীন প্রচেষ্টা রাতারাতি বদলে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে দেশটির দুই সাংবাদিকের গোপনে ধারণকৃত একটি ভিডিওতে। এই সাংবাদিকদের ভিডিও ধারণ এবং সংবাদের জন্য তথ্য সংগ্রহে বাধা দিয়েছিল দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।
গত বছরের জানুয়ারিতে ভিডিও ধারণ করলেও সম্প্রতি এই ভিডিও কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার অনুসন্ধানী দলের কাছে হস্তান্তর করেন চীনা ওই দুই সাংবাদিক। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে গত বছরের ১৯ থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে যান তারা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রদেশের হাসপাতালগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষের এই শহরের রাতারাতি বদলে যাওয়ার চিত্র গোপনে ভিডিওতে ধারণ, তথ্য সংগ্রহ করেন ওই দুই সাংবাদিক।
আলজাজিরা এই দুই সাংবাদিকের গোপন ভিডিও পেলেও নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করেনি। তিনদিন উহানের চিত্র ধারণ করলেও চীনা ওই দুই সাংবাদিক এতদিন সেই ভিডিও কোথাও প্রকাশ করতে পারেননি।
পুরোপুরি লকডাউন কার্যকর হওয়ার আগে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে যান স্থানীয় সাংবাদিক ইয়াং জুন এবং চেন ওয়েই (পরিবর্তিত নাম)। সেই সময় উহানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল একশ’র নিচে। এই ভাইরাসের বিস্তারের ব্যাপারে চীন সরকার তথ্য প্রকাশে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করে।
দুই সাংবাদিক উহানের বিভিন্ন হাসপাতালে যান। তারা দেখতে পান- হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়।
হুনানের সামুদ্রিক খাবার বিক্রির যে বাজারকে করোনা প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্র হিসেবে মনে করা হয়; সেই বাজারে তাদের যেতে বাধা দেয় পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
গুরুত্বপূর্ণ প্রথম দিন
সাংবাদিক ইয়াং জুন এবং চেন ওয়েই উহানে পৌঁছান গত বছরের ১৯ জানুয়ারি। তখনও করোনাভাইরাসের তীব্রতা ছিল অজানা, নিশ্চিত হওয়া যায়নি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার তথ্য। যে কারণে সেখানকার নাগরিকদের এই ভাইরাসের ব্যাপারে পরিষ্কার কোনও ধারণা ছিল না। কেউই মাস্ক পরতেন না। তবে তারা এটিকে অন্যান্য ফ্লুর মতো মনে করেছিলেন।
এমনকি ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে যে সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল করোনার প্রাদুর্ভাবকে সেটির চেয়ে খারাপ মনে করতেন না চীনারা। সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
ইয়াং জুন তার ডায়েরিতে লিখেছেন, আমি পৌঁছে দেখতে পাই ভাইরাসটির ব্যাপারে সেখানকার মানুষের মধ্যে কোনও ভয় কিংবা উদ্বেগ নেই। এমনকি কেউ কেউ এই ভাইরাসের ব্যাপারে কিছুই শোনেননি।
এক দোকানের মালিক আমাকে মাস্ক খুলে ফেলতে বলেন। তিনি বলেন, আপনি অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন একজন বহিরাগত। এখানে সবকিছু ঠিক আছে
সাংবাদিক জুন
কিন্তু ইতোমধ্যে হুনান মার্কেট বন্ধ করে দিয়ে কর্তৃপক্ষ ভাইরাসের উৎসের খোঁজে তদন্ত শুরু করেছে। কিন্তু ভাইরাসের সম্ভাব্য তীব্র পরিস্থিতির ব্যাপারে উহান কিংবা বেইজিংয়ের সরকারি কর্মকর্তারা কোনও ধরনের তথ্য তখন পর্যন্ত প্রকাশ করেননি; যা দেশটির নাগরিকদের অন্ধকারে ফেলে দেয়। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) সেই সময় ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের সতর্কতা জারি করে। কিন্তু চীন এবং ডব্লিউএইচও তখনও এই ভাইরাসের মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি।
চীনা নববর্ষ ঘিরে লাখ লাখ নাগরিক যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া শুরু করেন, তখন সরকার শহরটি পুরোপুরি লকডাউনে যাবে বলে ঘোষণা দেয়। সরকারের এই ঘোষণার পর সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। জনসম্মুখে প্রায় প্রত্যেকে মাস্ক পরা শুরু করেন।
উহান কিংবা বেইজিংয়ের সরকারি কর্মকর্তারা কোনও ধরনের তথ্য তখন পর্যন্ত প্রকাশ করেননি; যা দেশটির নাগরিকদের অন্ধকারে ফেলে দেয়।
সরকারের এই ঘোষণা অনেক দেরীতে এসেছে; কারণ ততক্ষণে চীনা চান্দ্রবর্ষ উদযাপনের জন্য উহানের লাখ লাখ মানুষ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছেন। পরে চীনজুড়ে তো বটেই বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটে।
শুরুর দিকে চীন সরকারের স্বচ্ছতা এবং তথ্যের অভাবের কারণেই এই ভাইরাস অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করা হয়; যা ডেকে আনে গত ১০০ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এক মহামারি। এই মহামারিতে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ২০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
উহানে কর্মী এবং সরঞ্জামের অভাবের কারণে অনেক রোগী সংক্রমিত হলেও চিকিৎসা নিতে পারেননি। এটি ছিল এক ধরনের তামাশা। হাসপাতালগুলো সত্য গোপন করেছিল।
সাংবাদিক জুন
সরকারের সেন্সরশিপ
সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে কীভাবে বাধা দেয়া হয়েছিল সেই চিত্র প্রকাশিত হয়েছে ওই ভিডিও ফুটেজ এবং ডায়েরিতে। যদিও এই সাংবাদিকরা বেইজিংভিত্তিক সরকারি গণমাধ্যমে কাজ করছিলেন এবং উহানের পৌর গণমাধ্যম বিভাগের অনুমতি নিয়েই সেখানে গিয়েছিলেন।
হুনানের মার্কেট থেকে শুরু করে হাসপাতাল প্রত্যেকটি জায়গায় পুলিশ সাংবাদিকদের বাধা দিয়েছে। জুন লিখেছেন, আমি স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন করতে পারিনি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও আমাদের পেছনে সবসময় লোক ছিল এবং গোয়েন্দা নজর রাখা হতো।
জুন বলেন, ‘উহানে সংবাদ সংগ্রহের তিনদিনই আমাকে পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্মীরা ধারাবাহিকভাবে বাধা দিয়েছেন। যে কারণে আমি বুঝতে পারি এই ভাইরাস কতটা মারাত্মক, স্পর্শকাতর এবং এই বিষয়ে সংবাদ তৈরি করা কতটা কঠিন। এটি সম্পূর্ণ কল্পনাতীত।’
গত ডিসেম্বরে চীনের প্রখ্যাত নাগরিক সাংবাদিক ঝ্যাং ঝ্যানকে চার বছরের কারাদণ্ড দেন দেশটির একটি আদালত। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন করায় তাকে এই দণ্ড দেয়া হয়।
বিশ্বজুড়ে মহামারি
ওই তিনদিনের কয়েক সপ্তাহ পর বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। বিশ্বের সব মহাদেশে পৌঁছানো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ কোটি ৫৫ লাখের বেশি মানুষ।
গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্বের কয়েক ডজন দেশে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু বিশ্বের সাড়ে সাতশ কোটির বেশি মানুষকে এই ভাইরাসের টিকা দেয়াই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ। সমাজ এবং অর্থনীতির যে ক্ষতি ডেকে এনেছে করোনাভাইরাস মহামারি তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর লাগবে।
উহান থেকে এই ভাইরাসের বিস্তার শুরু হলেও চীনের কোনও নাগরিকই এ ব্যাপারে কোনও কথা বলার সাহস পান না।
উহান এখন তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। কিন্তু লোকজন এখনও এই ভাইরাসের ব্যাপারে আর কোনও কথা বলেন না। এটি অনেকটা ইতিহাসের মতো; যা অনেক আগে অতীত হয়ে গেছে।
সাংবাদিক চেন ওয়েই
তিনি বলেন, লোকজন নিজেদের অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করেন। চীনের নাগরিক হওয়ায় তারা গর্ববোধ করেন। কারণ বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে চীনই এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। চেন বলেন, এটি সত্য নাও হতে পারে। তবে চীনের অধিকাংশ মানুষই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সরকার সফল হয়েছে বলে মনে করেন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলজাজিরাকে বলেছে, মহামারির শুরুর দিকে নেয়া পদক্ষেপের কারণে এই ভাইরাসের বিস্তার তাৎপর্যপূর্ণভাবে রোধ করা গেছে। কিন্তু সাংবাদিকদের বাক-স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে চীন সরকার কোনও মন্তব্য করেনি।
ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে
এসএস