মিয়ানমারে অভ্যুত্থানে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড়, সু চির মুক্তির দাবি

সামরিক অভ্যুত্থানে ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি-সহ মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেতাদের আটকের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় শুরু হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর অর্ধ-দশক না পেরোতেই সামরিক বাহিনীর এই অভ্যুত্থানের নিন্দা ও আটক নেতাদের দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ওয়াশিংটন সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফল কিংবা মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের বিকল্প যেকোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন সব সরকারি কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের নেতাদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, শান্তি এবং উন্নয়নের প্রতি বার্মার জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে। সামরিক বাহিনীর তাদের পদক্ষেপ থেকে এখনি সরে আসা উচিত।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মারিজ পেইনি বলেন, আমরা আইনের শাসন মেনে চলতে, আইনি প্রক্রিয়ায় চলমান দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তিতে এবং বেসামরিক সব নেতা ও অন্য যাদের বেআইনিভাবে আটক করা হয়ে সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে সামরিক বাহিনীকে আহ্বান জানাচ্ছি।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন সিফটন বলেন, প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা যারা কয়েক দশক ধরে দেশটিকে শাসন করেছে তারা কখনোই আসলে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়নি। তারা কখনোই বেসামরিক কর্তৃপক্ষের শাসন মেনে নেয়নি, আর তাই আজকের ঘটনা আসলে এতদিন ধরে চলা অবস্থারই প্রকাশ মাত্র।
ইয়াঙ্গুনভিত্তিক ইতিহাসবিদ এবং লেখক থ্যান্ট মিয়ন্ত ইউ বলেন, ভিন্ন ধরনের একটি ভবিষ্যতের দরজা খুললো মাত্র। আমার মনে হচ্ছে যে, পরবর্তীতে যা ঘটতে যাচ্ছে তা আসলে কেউই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
অং সান সু চি ও প্রেসিডেন্টকে গ্রেপ্তারের পর মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব জেনারেল।
নতুন প্রেসিডেন্ট সাবেক জেনারেল
এদিকে, মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউ মিন্ট সুয়েকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সোমবার ভোরে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাকে দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি। সেনাবাহিনীর সাবেক এই প্রভাবশালী জেনারেল আগামী বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন বলে জানানো হয়েছে।
অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন মিওয়াদি টিভি-তে এই ঘোষণা দেন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ইউ মিন্ট সুয়ে।
এর আগে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি ও দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে আটক করা হয়। এমনকি বিভিন্ন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদেরও বা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি ও দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ ক্ষমতাসীন এনএলডি’র শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে আটকের কয়েক ঘণ্টা পর টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয় দেশটির সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা। এসময় জরুরি অবস্থা জারি ও সেনাপ্রধান মিং অং হ্লেইংয়ের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা জানায় তারা।
কেন এই অভ্যুত্থান?
গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে দেশটির ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের প্রধান অং সান সু চি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান টানাপোড়েনের কারণে দেশটিতে অভ্যুত্থান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নভেম্বরের ওই নির্বাচনে অং সান সু চির দল এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তোলে সেনাবাহিনী। আজ সোমবার নব-নির্বাচিত সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল।
কী হয়েছিল দেশটির সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে? এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও নির্বাচনের সার্বিক ফলাফল এবং সু চির বিরোধী নেতাদের বক্তব্যই বা কি ছিল?
গত বছরের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে দ্বিতীয়বারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মতো দ্বিতীয় নির্বাচনেরও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)।
মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি পার্লামেন্টের ৫০০ আসনের মধ্যে জয়লাভ করে ৩৯৯টি আসনে। আর ২০১৫ সালে প্রথমবারের নির্বাচনে এনএলডি পেয়েছিল ৩৯০টি আসন। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩২২টি আসন। তবে এই নির্বাচনে রোহিঙ্গাসহ অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভোটাধিকার ছিল না।
গত নির্বাচনে অং সান সু চির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। এই দলটিকে দেশটির সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়।
নির্বাচনে এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও এই ফলাফলকে স্বীকৃতি না দেওয়ার ঘোষণা দেয় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সমর্থিত বিরোধী দলটি। ভোট সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি, তাই নতুন করে আবারও ভোটের আয়োজন করার জন্য সেসময় নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানায় তারা।
এসএস