প্রতারণাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ‘মেধাবী প্রতারক’ নুরের গল্প

চট্টগ্রামে হালিশহর এলাকার বিস্ময়কর যুবক নুর মোহাম্মদ শাহেদ। প্রতারণাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। একের পর এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়াকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। কেউ অভিযোগ দিলে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। পরে আবার বের হয়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করে প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন।
পুলিশ বলছে, প্রতারণা করতে গিয়ে মেধার পরিচয় দিচ্ছেন শাহেদ। যে কারণে তার পাতানো ফাঁদে সহজেই পা দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
জানা যায়, পুলিশের মামলা ও গ্রেপ্তার সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জমা থাকে সিডিএমএস (ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) নামে একটি ওয়েবসাইটে। যেখানে কারও নাম-ঠিকানা দিয়ে সার্চ দিলে একজনের নামে কয়টি মামলা রয়েছে এবং আগে কখনও ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে থাকলে তার তথ্য সংরক্ষিত থাকে। এই সিডিএমএসে শাহেদের নাম-ঠিকানা দিয়ে সার্চ দিলে তার নামে চারটি মামলা পাওয়া যায়। সবগুলো মামলায় প্রতারণা সংক্রান্ত। এসব মামলায় চারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি।
সবশেষ গত ৩০ জানুয়ারি প্রতারণার একটি মামলায় নগরের হালিশহর থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন শাহেদ। বর্তমানে রয়েছেন কারাগারে।

সিডিএমএসের তথ্য অনুযায়ী, শাহেদের নামে ২০২১ সালের ২৫ জুন নগরের ইপিজেড থানায় মামলা রেকর্ড হয়। এরপর ২০২২ সালের ৩ আগস্ট খুলশী, ২০২৩ সালের ৩০ মে হালিশহর এবং সবশেষ গত ৩০ জানুয়ারি একই থানায় আরেকটি মামলা রেকর্ড হয়। এসব মামলায় শাহেদ ২০২১ সালের ২৫ জুন ইপিজেড থানা পুলিশের হাতে, ২০২২ সালের ১২ আগস্ট খুলশী থানা পুলিশের হাতে, ২০২৩ সালের ৩১ মে হালিশহর থানা এবং গত ৩০ জানুয়ারি একই থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
আরও পড়ুন
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া সচরাচর প্রতারণার অভিযোগের মামলা থানায় রেকর্ড হয় না। এ ধরনের অভিযোগে আদালতেই বেশিরভাগ মামলা হয়ে থাকে। আর আদালতে মামলা হলে সেগুলো পুলিশের ওয়েবসাইটে রেকর্ড থাকে না। শুধু থানায় মামলা হলে পুলিশের ওয়েবসাইটে রেকর্ড থাকে। শাহেদের নামে শুধু থানার মামলা পাওয়া গেছে চারটি। এর বাইরে আদালতে দায়ের হওয়া মামলাও থাকতে পারে।
তারা আরও বলছেন, থানায় কারও নামে চারটি মামলা থাকা মানে তিনি বড় ধরনের প্রতারক। তা ছাড়া ওয়েবসাইটে শাহেদের প্রোফাইলে প্রতারক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেভাবে প্রতারণা করেন শাহেদ
নুর মোহাম্মদ শাহেদ ফেনী জেলার শর্শাদি ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য মোহাম্মদ নুর নবীর ছেলে। বাবার চাকরির সুবাদে নগরের হালিশহর থানার গোলন্দাজ সড়কে আর্টিলারির পাশেই বড় হয়েছেন তিনি। এই এলাকায় নৌবাহিনীর কিছু সদস্য ভাড়া বাসায় থাকেন। এ কারণে নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শাহেদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। নৌবাহিনীর সদস্যদের যাদের বাড়ি চট্টগ্রামের বাইরে তাদের অনেকেই প্রাপ্ত রেশন বিক্রি করে দেন। শাহেদ এসব রেশন কিনে বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময়ে দুরন্ত বাজার নামে একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নৌবাহিনীর লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার কারণে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জানতেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় শাহেদ নিজেকে পরিচয় দেন নৌবাহিনীর সাব-লেফটেন্যান্ট। ২০২২ সালের ১২ আগস্ট গ্রেপ্তারের সময় খুলশী থানা পুলিশ শাহেদের কাছ থেকে নৌবাহিনীর ইউনিফর্ম, ক্যাপ, বেল্ট, ব্যাগ, জুতা, দুটি নেভির বুট জুতা, নেমপ্লেট, র্যাঙ্ক ব্যাজ ও রেড ব্যাজসহ বিভিন্ন সামগ্রী জব্দ করে।
ওই ঘটনার ভুক্তভোগী ছিলেন ওমর ফারুক নামে এক ব্যবসায়ী। শাহেদ গ্রেপ্তারের কয়েক মাস আগে ভুক্তভোগীর মালিকানাধীন শো-রুম থেকে একটি মোটরসাইকেল কেনেন। সেই সুবাদে ওমর ফারুকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

এ ব্যবসায়ী জানান, শাহেদ নৌবাহিনীর সাব-লেফটেন্যান্ট বলে পরিচয় দেয়। এতে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং একে অপরের বাসায় যাওয়া-আসা শুরু করেন। ২০২২ সালের ১০ জুন শাহেদ তার প্রতিষ্ঠানে যান। তখন সিলেটে বন্যা ছিল। শাহেদ তাকে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের প্রস্তাব দেন। তিনি রাজি হলে শাহেদ তার মালিকানাধীন দুরন্ত বাজার থেকে কম দামে চাল, চিনি ও সয়াবিন তেল বিক্রির ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অর্ডার অনুযায়ী মোট পণ্যের দাম ৩৩ লাখ ২০ হাজার টাকা বলে জানান। শাহেদের প্রস্তাব পেয়ে তিনি নগদ ও চেকের মাধ্যমে ২০ লাখ টাকা দেন। কিন্তু শাহেদ পণ্য সরবরাহ না করে লাপাত্তা হয়ে যান।
সবশেষ গত ৩০ জানুয়ারি হালিশহর থানায় রেকর্ড হওয়া মামলা সূত্রে জানা যায়, মাহমুদা আক্তার নামে এক নারী ভুক্তভোগী বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন— তার ভাতিজা মো. রেজাউল হক শিশিরের সঙ্গে ব্যবসায়িকভাবে পরিচয় হয় শাহেদের। পরে শাহেদ তার কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে চিনি, ডাল, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়ের প্রস্তাব দেয় শিশিরকে। প্রস্তাবে রাজি হয়ে ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল সাহেদের ইউসিবি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১২ লাখ টাকা এবং নগদে এক লাখ টাকাসহ সর্বমোট ১৩ লাখ টাকা প্রদান করেন। কিন্তু এসব টাকা নিয়ে মালামাল দেননি শাহেদ।
পুলিশের নথিতে শাহেদকে পেশাদার প্রতারক উল্লেখ করে আরও বলা হয়, শাহেদ প্রতারণার মাধ্যমে ভুক্তভোগী মো. আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা, সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে দুই লাখ ৬৫ হাজার টাকা, তানজিফুল আলমের কাছ থেকে ১৪ লাখ ১৫ হাজার ৮৫০ টাকাসহ আরও বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নানা কৌশলে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।
সুপারশপ ঘিরে সুপার প্রতারণা
হালিশহর থানার জি-ব্লক এলাকায় দুরন্ত বাজার নামে শাহেদের মালিকানাধীন একটি সুপারশপ রয়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, খুব বেশি মালামাল নেই দোকানটিতে। বেশ কিছু তাক একেবারে খালি। দোকানের পেছনে একটি অফিস কক্ষ রয়েছে। সেখানেই বসেন ম্যানেজার মো. রফিকুর। প্রতিবেদক যখন দোকানে তখনও তার সঙ্গে কথা বলছিলেন দুই পাওনাদার।
দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৩০ জানুয়ারি শাহেদ হালিশহর থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে প্রতারকরা দোকানেই ভিড় করছেন। গত কয়েকদিনে অন্তত একশ পাওনাদার দোকানে গেছেন। যাদের কাউকে সুপারশপে বিনিয়োগ করার কথা বলে শাহেদ টাকা নিয়েছে, আবার কাউকে সস্তায় মালামাল বিক্রির কথা বলে অগ্রিম টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ তিন কোটি টাকার পাওনাদার রয়েছে।

এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই বিব্রত হন দোকানের ম্যানেজার রফিকুর। তিনি বলেন, ‘আমরা চাকরি করি। এগুলো মালিকের বিষয়। শিগগিরই উনার জামিন হবে। এরপর উনি বিষয়গুলো হ্যান্ডেল করবেন।’
আরও পড়ুন
হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের মামলায় শাহেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। শাহেদের বিরুদ্ধে প্রতারণার একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগেও একাধিকবার প্রতারণা মামলায় শাহেদ কারাগারে গিয়েছেন।’
বর্তমানে কারাগারে থাকায় অভিযোগের বিষয়ে নুর মোহাম্মদ শাহেদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এমআর/এমজে