৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছিল ‘প্রোটেকশন মানি’ হিসেবে!

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫ নেতা। তারা গুলশানের বাসিন্দা সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের স্বামী সিদ্দিক আবু জাফরের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। ‘প্রোটেকশন মানি’ হিসেবে এই টাকা চাওয়া হয় বলে দাবি করেন ভুক্তভোগী।
তিনি জানান, আমাদের প্রোটেকশন হিসেবে তারা এ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে আওয়ামী লীগের দোসর বলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে তাদের হাতে নগদ ১০ লাখ টাকা তুলে দেন সিদ্দিক আবু জাফর। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট না থেকে চাহিদা মতো বাকি ৪০ লাখ টাকা চাঁদা নিতে আরও কয়েকবার শাম্মীদের বাড়িতে যান ওই নেতারা। সেখানে গিয়ে অবশেষে ধরা পড়েন পুলিশের হাতে।
এ ঘটনায় রোববার (২৭ জুলাই) শাম্মী আহমেদের স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
গ্রেপ্তার তরুণদের বিষয়ে যা জানা গেল
পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৫ জন হলেন— মো. সাকাদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব, মো. আমিনুল ইসলাম, ইব্রাহীম হোসেন মুন্না ও আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ।
পাঁচজনের মধ্যে চারজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন কমিটিতে আছেন। এর মধ্যে ইব্রাহীম হোসেন মুন্না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক। একই কমিটির সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব।
আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ নামে আরেকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সদস্য।
এছাড়া আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ পুলিশ সংস্কার কমিশনের মেম্বার বলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টের মাধ্যমে দাবি করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব মাহিন সরকার।
তিনি তার পোস্টে লেখেন, আব্দুর রাজ্জাক নামে যে ছেলেটা গ্রেপ্তার হয়েছে সে পুলিশ সংস্কার কমিশনের মেম্বার। অর্থাৎ, গুরুত্বের বিচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের সে লিস্টেড ছাত্র প্রতিনিধি। বাংলাদেশে যে কালচার চলে তাতে সে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত, এই পরিচয়েই অর্থ উপার্জন করতে পারে। তার মতো ব্যক্তিকে কীভাবে স্বরাষ্ট্র বিভাগের পুলিশ সংস্কার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সুপারিশ করা হলো এটা সামনে আনা প্রয়োজন।
রিয়াদের পরিচয় নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আল আমিন হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তার পরিচয়ের বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত কিছু বলতে পারব না। তবে তিনি আমাদের কাছে দাবি করেছেন, তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাওয়া আসা করেন।
বেকায়দায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
চাঁদা দাবির অভিযোগে নিজেদের পাঁচজন গ্রেপ্তার হওয়ায় বেশ বিপাকে পড়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সারা দেশে নানামুখী সমালোচনার মধ্যে পড়েছে এ সংগঠন। এরই মধ্যে তিনজনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার করেছে সংগঠনটি।
বহিষ্কৃতরা হলেন— বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন মুন্না, সদস্য মো. সাকাদাউন ও সাদাব। শনিবার (২৬ জুলাই) রাতেই তাদের বহিষ্কার করা হয়।
এ দিকে আজ রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সব কমিটি স্থগিত ঘোষণা করেছেন সংগঠনটির সভাপতি রশিদুল ইসলাম রিফাত।রাজধানীর শাহবাগে চলমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ডাকা এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তিনি।
বাড়িতে থাকেন না শাম্মী আহমেদ
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদ বর্তমানে বিদেশে আছেন। তার গুলশানের বাসায় আছেন স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর।
জানতে চাইলে গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে এবং আদালত আসামিদের ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন।
আসামিরা চাঁদাবাজি করেছিল কি না জানতে চাইলে ওসি বলেন, তারা সাবেক এমপির স্বামীর কাছে টাকা দাবি করেছিল। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে এ টাকা দাবি করা হয়েছিল।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আল আমিন হোসাইন বলেন, মামলা হয়েছে, আসামিদের আদালতে পাঠাতে বলেছি।
চাঁদাবাজরা কী বলে চাঁদা দাবি করেছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।
মামলার এজাহারে যা আছে
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, মো.আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রিয়াদ (২৩), কাজী গৌরব ওরফে অপু (২৩), সাকাদাউন সিয়াম (22), সাদমান সাদার (২১) ও মো.ইব্রাহিম হোসেন (২৪) ও মো. আমিনুল ইসলাম (১৬) সহ অজ্ঞাতনামা ১০/১২ জন ব্যক্তি আমার গুলশান থানাধীন গুলশান-২ এর ৮৩ নম্বর রোডের বাসায় সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে গত ১৭ জুলাই সকাল ১০টায় আসে। এর মধ্যে রিয়াদ ও অপু বাসায় প্রবেশ করে আমাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে ৫০ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করানোর হুমকি দিয়ে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমি বাধ্য হয়ে তাদের ১০ লাখ টাকা দিই।
পরে গত ১৯ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় রিয়াদ ও অপু আমার বাসার দরজায় সজোরে ধাক্কা মারে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি বিষয়টি গুলশান থানা পুলিশকে জানাই।
সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই রিয়াদের নেতৃত্বে বাকি আসামিরা আবার আমার বাসার সামনে এসে আমাকে খুঁজতে থাকে। আমি বাসায় না থাকায় আমার বাসার দারোয়ান মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমাকে বিষয়টি জানায়। আমাকে তারা বলে চাঁদার বাকি ৪০ লাখ টাকা না দিলে তারা আমাকে পুলিশকে ধরিয়ে দেবে। পরে আমি বিষয়টি দ্রুত গুলশান থানা পুলিশকে জানাই। পুলিশ এসে হাতেনাতে পাঁচ চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করে।
চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চান সাধারণ মানুষ
গুলশানে চাঁদা দাবি করা এবং চাাঁদার টাকা গ্রহণের একটি সিসিটিভি ফুটেজ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রচার হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক সমালোচনা চলছে।
অনেকে বলছেন, জাতি যাদের হাতে ভবিষ্যতের দেশ দেখতে চেয়েছিল তারা এখন মানুষের বাসায় গিয়ে চাঁদাবাজি করছে। এটা খুবই দুঃখজনক! অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হাতে এসব চাঁদাবাজদের দমন করতে হবে। যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে মানুষের বাড়িতে গিয়ে চাঁদাবাজি করছে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে চাঁদার জন্য তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনি পদক্ষেপ দেখতে চান তারা।
এমএসি/এআইএস