উন্নয়ন স্পৃহার আরেক ধাপ পদ্মা সেতুতে রেল
শিল্প আর সেবা খাতকে উন্নত করতে হলে কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো করতে হবে। এই কথাটা বুঝতে পেরে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার তার ক্ষমতারোহণের একেবারের শুরুতেই এই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সরকার পরিচালনা শুরু করেছিলেন। টানা তৃতীয়বারের মতো সরকারে থেকে অনেক বড় প্রকল্প করেছেন যেগুলো কেউ সেইভাবে আগে ভাবতে পারেননি।
তেমনি এক প্রকল্প পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের কোটি মানুষের এই সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পর বদলে গেছে দক্ষিণ বাংলার একুশ জেলার চালচিত্র। মানুষ শুধু দ্রুত কেন্দ্রে আসা যাওয়া করতে পারছে তা নয়, বরং বলা চলে কৃষি, মৎস্য, শিল্প ও সেবাখাতের প্রসারে নিজেদের নিবেদিত করতে পারছে।
এইবার সেই সেতুতে চালু হচ্ছে রেল যোগাযোগ। ১ নভেম্বর থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল করছে। এইদিন থেকে যাত্রীবাহী দু’টি ট্রেন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করবে।
আরও পড়ুন
পদ্মার ওপর কোনো সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে, এটা ছিল অনেকের কল্পনার বাইরে। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করেই প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত হয়েছে সেতু। সেই সেতুতে রেল চলাচলের সুবিধাও যুক্ত করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে অবদান রাখছে। সেই অভিযাত্রায় আরও গতি সৃষ্টি করবে রেল যোগাযোগ।
দক্ষিণ বাংলার মানুষের কয়েক প্রজন্মের কর্মজীবন অতিবাহিত হয়ে গেছে রেল-বিচ্ছিন্নতায়। বৃহত্তর বাংলার উন্নততর অর্থনীতি ও জনজীবনে যোগ দেওয়ার সুযোগ তারা পাননি। ভৌগোলিক দূরত্ব মানব উন্নয়ন ও আর্থনৈতিক দূরত্ব বাড়ায়। সেইটাই ঘটেছিল দেশের এই অংশে।
পদ্মা সেতু ও নবনির্মিত রেললাইন ধরে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় কেন্দ্র থেকে প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া সেই একুশটি জেলার কোটি কোটি মানুষের নিকট আশীর্বাদ। এতে তাদের বিচ্ছিন্নতা আরও কিছুটা ঘুচবে। ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন হওয়ায় এই অঞ্চলের অবকাঠামো ও সংযোগ ব্যবস্থায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, যদিও প্রকল্প নিয়ে এই দেশে বিতর্ক কম নয়। সময় এবং খরচ বৃদ্ধি বড় আলাপ প্রয়োজন আছে আমাদের।
পদ্মার ওপর কোনো সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে, এটা ছিল অনেকের কল্পনার বাইরে। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করেই প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত হয়েছে সেতু। সেই সেতুতে রেল চলাচলের সুবিধাও যুক্ত করা হয়েছে।
পদ্মা নদীর ছয় কিলোমিটারের পানির প্রবাহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে এই দেশের বাকি অংশ থেকে পৃথক করে রেখেছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাধ্যমে এই ব্যবধান ঘুচেছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের বাকি অংশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এই ব্যবধান এখন আর নেই। তাই যারা বিতর্ক করছেন তাদের বলতে হচ্ছে যে, বাজেটের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পদ্মা সেতু প্রকল্পটি খরচের তুলনায় লাভজনক। সেতুর জন্য ব্যয়িত প্রতি টাকা প্রায় দুই টাকা সমমূল্যের সামাজিক কল্যাণ সাধন করতে পারছে।
আরও পড়ুন
পদ্মা রেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে রেল যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। বর্তমানে ঢাকা থেকে যশোর যেতে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেলসংযোগ চালু হলে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় আসা-যাওয়া করা যাবে। এই রেল যোগাযোগ আর্থ সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
মানুষ এখন ভাবতে শুরু করেছে যে, যশোর থেকে ঢাকায় গিয়ে অফিস করে আবার যশোরে ফেরা যাবে। এমন কথা আগে কল্পনাও করা যায়নি। পদ্মা সেতুতে রেল লিংক হচ্ছে বলেই এইরকম ভাবা সম্ভব হচ্ছে।
মানুষ এখন ভাবতে শুরু করেছে যে, যশোর থেকে ঢাকায় গিয়ে অফিস করে আবার যশোরে ফেরা যাবে। এমন কথা আগে কল্পনাও করা যায়নি। পদ্মা সেতুতে রেল লিংক হচ্ছে বলেই এইরকম ভাবা সম্ভব হচ্ছে।
পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল শুরু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ত্রিমাত্রিক (সড়ক, নৌপথ ও রেলযোগাযোগ) যোগাযোগের যুগে প্রবেশ করবে। এর ফলে শুধু ব্যক্তি যোগাযোগই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেও নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
পদ্মা সেতু রেল-সংযোগ প্রকল্পটি ভাঙ্গা পর্যন্ত আংশিকভাবে উদ্বোধন করা হলেও এটি যশোর পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করবে। পরে যশোর থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত যুক্ত হবে। ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হিসেবে নির্মিত এই রেলপথের ধারণক্ষমতা এবং চলাচলের গতিও হবে অনেক বেশি।
সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় সম্ভাবনার দ্বার তৈরি হয়েছে। আর এই সম্ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করতে চলেছে পদ্মার সেতু রেলপথ। নড়াইলের অরুনিমা রিসোর্টের কর্ণধার জানিয়েছেন, প্রায় বন্ধ হতে যাওয়া এই রিসোর্টটি এখন আবার মানুষের পদভারে চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
পদ্মা সেতুর উপর এই রেললাইন ঘিরে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে রেলকে কেন্দ্র করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কম খরচে মালামাল পরিবহন করা সম্ভব হবে। আগামী দিনগুলোয় যত শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে তার বেশিরভাগই হবে দক্ষিণাঞ্চলে।
পদ্মার ওপর রেল সেতু নতুন উদ্যম আনছে অর্থনীতিতে। দেখার পালা আমরা নিজেরা কতটা পরিকল্পিতভাবে তাকে কাজে লাগাতে পারছি। বলে রাখা দরকার সেতু আর যোগাযোগ অবকাঠামোর পাশাপাশি প্রয়োজন সঠিক ভূমি ব্যবহার নীতিমালা। যেমন তেমন করে শিল্প আর সেবা খাত গড়ে উঠতে থাকলে উপকারের চেয়ে অপকার হবে বেশি।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন