অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণই লক্ষ্য

০২ জুন ২০২৫ অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার এই বাজেট পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় আকারে কিছুটা ছোট। একে বাস্তববাদী ও জনকল্যাণমুখী হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প হ্রাস এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন ও কর্মসংস্থানের মতো জরুরি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এটি স্থিতিশীলতা ও ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে হ্যাঁ, এই আশার আলোর মাঝেও কিছু ধূসর ছায়া উঁকি দিচ্ছে। বেসরকারি খাত, বিশেষত আমাদের অর্থনীতির প্রাণ এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) এবং তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাজেট যেন কিছুটা নীরব।
দেশের বিভিন্ন থিংক ট্যাঙ্ক ও সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন ইতিমধ্যেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে বরাদ্দ কমানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবুও চলুন, বাজেটের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো দেখে আসি, আর পাশাপাশি কোথায় কোথায় আমাদের আরও নজর দেওয়া দরকার, সে বিষয়েও একটু আলোচনা করি।
এই বাজেটের সবচেয়ে প্রশংসনীয় দিক সম্ভবত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯.০৫ শতাংশের কাছাকাছি। লক্ষ্য ২০২৬ অর্থবছরে এটিকে ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। অর্থ উপদেষ্টা জোর দিয়েই দাবি করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর থেকে মূল্যস্ফীতি ক্রমশ কমছে – যদিও প্রতিদিনকার বাজারে তা সহসা টের পাওয়া যাচ্ছে না। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯.১ শতাংশ থেকে কমেছে এবং এই মাসে নাকি তা ৮ শতাংশে নামতে পারে। এটুকু খবর তো আমাদের জন্য খানিকটা স্বস্তির।
কীভাবে কমবে এই মূল্যস্ফীতি? কৌশলটা হলো, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান বাড়ানো। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা – যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বেশ সহনীয়। এর মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা আসবে বিদেশি উৎস থেকে, আর ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা দেশের ভেতর থেকে।
এই কৌশল যদি ঠিকঠাক কাজ করে, তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সরকারের ঋণের চাপ কমবে, আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তা সাহায্য করবে। তবে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম আর ডলারের বিনিময় হার – এই দুটি বিষয় যে আমাদের লক্ষ্য পূরণের পথে বড় চ্যালেঞ্জ, তা ভুলে গেলে চলবে না।
আগের সরকারগুলোর সময়ে আমরা মেগা প্রকল্পের নামে অনেক অর্থ ব্যয় হতে দেখেছি। এই বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, জনকল্যাণই তাদের মূল লক্ষ্য। অর্থাৎ এবার অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।
নতুন কোনো মেগা প্রকল্প শুরু করার পরিকল্পনা নেই, বরং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ আর প্রয়োজনীয় অবকাঠামোকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দেবে, তেমনই মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
বাজেটের সবচেয়ে প্রশংসনীয় দিক সম্ভবত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯.০৫ শতাংশের কাছাকাছি। লক্ষ্য ২০২৬ অর্থবছরে এটিকে ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা।
পাশাপাশি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাও বাড়ানো হচ্ছে। ১৪০টির বেশি প্রকল্প থেকে সংখ্যা কমিয়ে ১০০টির নিচে আনা হবে এবং চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ৩৮টি প্রকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। প্রায় ১০ লাখ নতুন মানুষ এই কর্মসূচির আওতায় আসবে, আর জনপ্রতি নগদ সহায়তাও ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়বে। এসব উদ্যোগ সমাজে বৈষম্য কমাতে অবদান রাখার কথা।
এইসব ইতিবাচক দিকের মাঝেও কিছু প্রশ্ন এসে যায়। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর অন্যতম মূল শক্তি হলো বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই)। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হয় এই খাতে। অথচ, বাজেটে এসএমই খাতের জন্য তেমন কোনো সুস্পষ্ট প্রণোদনা বা সহায়তা প্যাকেজ দেখা যাচ্ছে না। ঋণ সুবিধা, কর ছাড় বা প্রযুক্তির সাহায্য – এমন কোনো বিশেষ উদ্যোগ থাকলে এই খাত আরও গতিশীল হতে পারতো।
আমাদের তরুণ সমাজ দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ। তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দক্ষতা উন্নয়ন যে কোনো সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। সাম্প্রতিক বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও পূর্বে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা সহায়তার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
আরও পড়ুন
তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেছেন, যা একটি ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই তহবিল তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে এবং নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া আত্মকর্মসংস্থানের জন্য যুব উদ্যোক্তাদের ঋণের সীমা ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করা এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগও সরকারের দূরদর্শী চিন্তাভাবনার পরিচায়ক।
একই সঙ্গে, দেশীয় ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি প্রশিক্ষণ ও সনদ প্রদানের ব্যবস্থা তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে চাকরি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাও তরুণদের মধ্যে আশা জাগানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এসব পদক্ষেপ তরুণদের হতাশা কাটিয়ে দেশের উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে সহায়ক হবে।
তবে এই প্রশংসনীয় উদ্যোগের পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। অথচ এই রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের জন্য কোনো বিশেষ সহায়তা বা প্রণোদনা প্রকল্প বাজেটে দৃশ্যমান নয়। তাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এবং তাদের উৎসাহিত করতে সরকারের উচিত এই খাতে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা।
তরুণদের পাশাপাশি প্রবাসীদের জন্যও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা বেশ উচ্চাভিলাষী। করদাতার সংখ্যা বাড়াতে আয়কর ফাইলিং প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে, আর করমুক্ত আয়ের সীমাও বাড়ানো হয়েছে।
নারী, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, তৃতীয় লিঙ্গ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো – এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তটি বেশ বিতর্কিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই সিদ্ধান্তকে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার শামিল এবং সংবিধানের লঙ্ঘন হিসেবে সমালোচনা করেছে। এই সুবিধা বাতিল করা এবং পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া গেলে বাজেট আরও স্বচ্ছ ও জনবান্ধব হতো।
বাজেটে এসএমই খাতের জন্য তেমন কোনো সুস্পষ্ট প্রণোদনা বা সহায়তা প্যাকেজ দেখা যাচ্ছে না। ঋণ সুবিধা, কর ছাড় বা প্রযুক্তির সাহায্য – এমন কোনো বিশেষ উদ্যোগ থাকলে এই খাত আরও গতিশীল হতে পারতো।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও জনকল্যাণের একটি সম্ভাব্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে একটি সুষম ও জনমুখী অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
তবে বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) এবং তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব এই বাজেটের কার্যকারিতা সীমিত করতে পারে। এছাড়াও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা এবং কর ব্যবস্থায় আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে বাজেটটি আরও কার্যকর হতে পারতো।
বাজেটের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনকল্যাণের প্রতি ঘোষিত অঙ্গীকার ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা তৈরি করে। তবে এই লক্ষ্য অর্জনে আরও দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এই বাজেট কি প্রত্যাশিত পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
ড. কাজী মারুফুল ইসলাম ।। অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
