জগৎ-পারাবারের তীরে শিশুর মহামেলা

নিশ্চিত নই যে, কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই কবিতাটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই সেই বাংলা কবিতাটি রচিত হয়েছিল কিনা যার একটি পঙ্ক্তির ভাব-সম্প্রসারণ বাংলাদেশে স্কুলগামী সবাইকেই জীবনে একবার লিখতে হয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখেছিলেন,
“My heart leaps up when I behold
A rainbow in the sky:
So was it when my life began;
So is it now I am a man;
So be it when I shall grow old,
Or let me die!
The Child is father of the Man;
And I could wish my days to be
Bound each to each by natural piety.”
অন্যদিকে ‘কিশোর’ কবিতায় গোলাম মোস্তফা লিখছেন, “আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে,/ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।/লক্ষ আশা অন্তরে/ঘুমিয়ে আছে মন্তরে/ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি-পাতার বন্ধনে।”
নজরুল তো স্বয়ং ঈশ্বরকেই ‘বিরাট শিশু’ আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।/প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে॥/শূন্যে মহা আকাশে/মগ্ন লীলা বিলাসে,/ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে॥/তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী,/পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি।”
রবীন্দ্রনাথের ‘জগৎ-পারাবারের তীরে শিশুর মহামেলা’ পড়তে গিয়ে আমি অবশ্য একটু থমকে গেলাম।
“জগৎ-পারাবারের তীরে/ছেলেরা করে মেলা।/অন্তহীন গগনতল/মাথার 'পরে অচঞ্চল,/ফেনিল ওই সুনীল জল/নাচিছে সারা বেলা।/উঠিছে তটে কী কোলাহল--/ছেলেরা করে মেলা।”
বাংলাদেশে শিশুদের গড় অবস্থান: পরিসংখ্যান ও আইনে
বাংলাদেশে শিশুদের গড়ে সার্বিক অবস্থা কেমন? ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিবেদন মতে, দেশে মোট ১৬৯.৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ (৫৬.৯ মিলিয়ন)-ই হচ্ছে শিশু বা ০-১৭ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী। এর ভেতর ০-১১ মাস বয়সীদের সংখ্যা ৩.৪ মিলিয়ন, ০-৫৯ মাস বয়সী বা পাঁচ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা ১৬.৩ মিলিয়ন এবং স্কুলগামী (৬-১৭) শিশুর সংখ্যা ৩৭.৬ মিলিয়ন।
দেশে জন্ম-নিবন্ধিত শিশুর শতাংশ হার ৫৬ এবং ৪৪ শতাংশ শিশু এখনো অনিবন্ধিত (পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের কথা বলা হচ্ছে)। প্রায় ৩০.১ শতাংশ শিশু রাস্তা, স্টেশন, টার্মিনাল এবং পার্কে ঘুমায়। পথে বসবাসরত শিশুদের প্রায় ৮২.৯ শতাংশ পথচারীদের কাছ থেকে নানা নিপীড়নমূলক আচরণের শিকার হয় এবং ৪৯.৮ শতাংশ শিশু কর্মক্ষেত্রে সন্ত্রাসের শিকার।
জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (৮.৭.১)’ অনুযায়ী ৬.৮ শতাংশ শিশু শিশু শ্রমে নিয়োজিত। আনুমানিক ৮ শতাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। সারা পৃথিবীতে শিশু বিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অষ্টম এবং এশিয়ার ভেতর প্রথম।
প্রায় ১১.৩ শতাংশ শিশু (৫-১৭ বছর বয়সী) নানা ধরনের শিশু শ্রম এবং বিশেষত, বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত থাকে। জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (৮.৭.১)’ অনুযায়ী ৬.৮ শতাংশ শিশু শিশু শ্রমে নিয়োজিত। আনুমানিক ৮ শতাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। সারা পৃথিবীতে শিশু বিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অষ্টম এবং এশিয়ার ভেতর প্রথম।
দেশে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির গড় হার ৯৭.৪২ শতাংশ, প্রাথমিক স্কুল শেষ করা শিশুর হার ৮৫.৮৫ শতাংশ, প্রাথমিক স্কুল থেকে ড্রপ-আউটের হার ১৪.১৫ শতাংশ, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিও হার ৭০.২৫ শতাংশ, মাধ্যমিক স্কুল শেষ করার হার ৬৪.২৪ শতাংশ এবং ঝরে পড়ার হার ৩৫.৬৬ শতাংশ।
পরিচ্ছন্নতায় অভিগম্যতার ক্ষেত্রে বাসায় শৌচাগার ব্যবহারের পর ন্যূনতম হাত ধোয়ার সুযোগ আছে ৫৮ শতাংশ শিশুর এবং স্কুলে এই হার ৫১ শতাংশ। স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ পায় মাত্র ৩৮ শতাংশ শিশু। (সূত্র: ইউনিসেফ)
শিশুদের আইনি সুরক্ষায় জাতিসংঘেরর ‘শিশু অধিকার সনদ (১৯৮০)’-এ স্বাক্ষর করা ছাড়াও বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে ‘দ্য চিলড্রেন অ্যাক্ট ২০১৩’, ‘দ্য ডমেস্টিক ভায়োলেন্স (প্রিভেনশন অ্যান্ড প্রটেকশন) অ্যাক্ট ২০১০’, ‘দ্য পেনাল কোড ১৮৬০’, ‘দ্য প্রিভেনশন অফ চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট ২০১৭’ এবং ‘দ্য সাপ্রেশন অফ ইমমর্যাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট ১৯৩৩’ নামের বহু আইন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশুরা কেমন আছে?
বাংলাদেশের প্রসঙ্গ বাদ দেই। সারা পৃথিবীতে শিশুরা সার্বিকভাবে কেমন আছে?
চুরি হওয়া শৈশব—
২৬৩ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যেতে পারে না।
১৬৮ মিলিয়ন শিশু শিশু শ্রমে নিযুক্ত।
অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী ১৫৬ মিলিয়ন শিশু অপুষ্টিতে খর্বাকৃতি।
৪০ মিলিয়ন কন্যা শিশু (১৫-১৯) বিবাহিত অথবা যৌন সম্পর্কে আছে।
২৮ মিলিয়ন শিশু তাদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
১৫-১৯ বছর বয়সী ১৬ মিলিয়ন কন্যা শিশু প্রতি বছর সন্তান প্রসব করে।
০-১৯ বছর বয়সী ৮ মিলিয়ন বালক-বালিকা প্রতি বছর মারা যায়।
২০১৫ সালে ৭৫,০০০ অনূর্ধ্ব-২০-এর বালক-বালিকারা খুন হয়েছিল।
সূত্র: অ্যান্ড অফ চাইল্ডহুড রিপোর্ট, সেভ দ্য চিলড্রেন (২০১৫)।
পৃথিবীর সেরা দশটি দেশে শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, সুখী এবং দশটি দেশে শিশুরা সবচেয়ে অনিরাপদ তার তালিকা তুলে ধরা হলো।
শিশুর জন্য নিরাপদতম দশটি দেশ—নরওয়ে, স্লোভেনিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, বেলজিয়াম, সাইপ্রাস, জার্মানি (সূত্র: অ্যান্ড অফ চাইল্ডহুড রিপোর্ট, সেভ দ্য চিলড্রেন, ২০১৫)।
ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য, গাইডবুক নির্ভরতা, জিপিএ-র আশায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা অভিভাবকদের মনে রাখা প্রয়োজন যে কাজী নজরুল ইসলাম স্কুলের গণ্ডিই পার হতে পারেননি। আইনস্টাইন ক্লাসের ‘মেধাবী’ শিক্ষার্থী ছিলেন না।
শিশুর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দশটি দেশ—আফগানিস্তান, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, মালি, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (সূত্র: সেভ দ্য চিলড্রেন)।
মূলত পিতৃত্ব এবং মাতৃত্ব ছুটি এবং দ্বি-ভাষিক বা বহু-ভাষী শিক্ষাব্যবস্থা (সুইডেন), কাজ ও ব্যক্তি জীবনের ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব এমন অর্থনীতির দেশ (পর্তুগাল একটি উদাহরণ), সর্বজনীন স্বাস্থ্য-সুরক্ষা (ইতালি), নিম্নতম অপরাধের হার (নরওয়ে) প্রভৃতি কারণে একটি দেশে শিশুর জীবন সুরক্ষিত, নিরাপদ থাকে এবং বিকশিত হয়। পাশাপাশি দারিদ্র্য-অশিক্ষা-সন্ত্রাস-সহিংসতায় আকীর্ণ দেশগুলোয় শিশুদের জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন।
আশার বিষয় হলো, বাংলাদেশ শিশুদের জন্য ভালো দশ দেশের ভেতর যেমন নেই, সবচেয়ে মন্দ দশ দেশের তালিকাতেও কিন্তু নেই। তারপরও দারিদ্র্য, নদী ভাঙনের কারণে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যূত, গ্রামীণ পরিবারগুলোর শহরাঞ্চলে বস্তিতে অভিবাসন, দরিদ্র শিশুদের নানা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম ও বিপজ্জনক কাজ বা অপরাধ চক্রে জড়িয়ে পড়া, স্বাস্থ্য ও শৌচাগার সুবিধার অভাব তো আছেই।
অন্যদিকে নগরাঞ্চলে মধ্যবিত্ত শিশুরা জীবনের নানা সুযোগ-সুবিধা বেশি পেলেও মহানগরীগুলোয় ‘ভালো’ স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকদের বিপুল যানজট ঠেলে বাচ্চাদের দূরের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, অত্যধিক পড়ার চাপ, ভালো জিপিএ-র তাড়ায় কোচিং-গাইড বুক নির্ভরতা তথা শিক্ষা বাণিজ্যের চক্রে ঢুকে যাওয়া এবং বেসামরিক এলাকায় বড় দুর্ঘটনা ঘটলে শিশুদের জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।
যদিও পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই (যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপান) শিশুরা তার নিজ এলাকার স্কুলেই পড়বে এবং নিরাপদে থাকবে- এমনটাই নিয়ম।
ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য, গাইডবুক নির্ভরতা, জিপিএ-র আশায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা অভিভাবকদের মনে রাখা প্রয়োজন যে কাজী নজরুল ইসলাম স্কুলের গণ্ডিই পার হতে পারেননি। আইনস্টাইন ক্লাসের ‘মেধাবী’ শিক্ষার্থী ছিলেন না। অবশ্যই সব শিশু আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথ হবে না। কিন্তু শিশুর সব সৃজনশীলতা ধ্বংস করে তাকে রোবটে পরিণত করাটাও অন্যায়। শিশুদের নিয়ে তাই রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারক ও পরিকল্পনাকারীদের বিশদ ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন।
অদিতি ফাল্গুনী : উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
