সেরিব্রাল পালসি : ভিন্নতার মাঝেও সম্ভাবনার আলো

৬ অক্টোবর বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি [Cerebral Palsy] (সিপি) দিবস। এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘অনন্য ও ঐক্যবদ্ধ’, যা উপস্থাপন করে ব্যক্তিগত ভিন্নতাকে স্বীকৃতি ও সম্মান জানিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শক্তিশালী সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। এ দিনটির উদ্দেশ্য হলো সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সীমাবদ্ধতাকে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা এবং তাদের সমাজের অন্তর্ভুক্তিকরণে উৎসাহিত করা।
সেরিব্রাল পালসি হলো একটি শারীরিক গঠনগত প্রতিবন্ধকতা, যা জন্মের আগে, জন্মের সময় বা জন্মের পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের আঘাতজনিত কারণে হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। জন্মের সময় এর প্রাদুর্ভাব উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় প্রতি ১,০০০ জীবিত শিশুর মধ্যে ১.৬ জন। বাংলাদেশে এ চিত্র আরও গভীর। বাংলাদেশের একটি জনসংখ্যাভিত্তিক জরিপে (২০১৮) দেখা গেছে যে, দেশের গ্রামীণ এলাকায় প্রতি ১,০০০ জন শিশুর মধ্যে প্রায় ৩.৪ জন শিশু সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত।
তবে এই পরিসংখ্যানের অন্ধকার ভেদ করে আমরা খুঁজে পেতে পারি আলোর দিশা। কারণ সেরিব্রাল পালসি কোনো বহুল প্রচারিত রোগ নয়। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং বিশেষ সহায়তা বদলে দিতে পারে একজন শিশুর জীবনকে। সেরিব্রাল পালসি সাধারণত মাংসপেশির বৃদ্ধি এবং পেশির নিয়ন্ত্রণের ওপর প্রভাব ফেলে, যার ফলে হাঁটাচলা, সোজা হয়ে বসা, কথা বলা এবং লালা পড়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। শুধু তাই নয়, শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি যোগাযোগ, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আচরণগত সমস্যাও দেখা দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৬৭ শতাংশের বেশি শিশু কথা বলার সমস্যায় ভোগে—যেমন অস্পষ্ট উচ্চারণ, শব্দ গঠন ও বোঝার সমস্যা, কিংবা প্রকাশ ক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা।
আরও পড়ুন
এরই প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসা সেবা, যা সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুর কথা বলা ও যোগাযোগ উন্নত করার পাশাপাশি খাবার খাওয়া এবং লালা পড়াজনিত সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু তাই নয়, যোগাযোগের এই দক্ষতা বৃদ্ধি তাদের আত্মবিশ্বাস এবং সমাজে অন্যান্য শিশুদের মতো অংশগ্রহণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশের সব সরকারি হাসপাতালগুলোয় স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসা সেবার সুযোগ নেই, শুধুমাত্র বেসরকারি উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল। যার ফলশ্রুতিতে অনেক সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুর প্রয়োজনীয় সেবা সঠিক সময়ে পেতে বিলম্ব হচ্ছে, যা তাদের বিকাশকে আরও বেশি বাধাগ্রস্ত করছে। এমতাবস্থায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগ ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশু সমাজের প্রতিবন্ধকতা নয় বরং সম্ভাবনার ভান্ডার। আজকের শিশু যদি সঠিক সেবা এবং সুযোগ পায়, তবে সে আগামীদিনের ডাক্তার, শিল্পী, শিক্ষক বা সমাজের যেকোনো স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারে। ভিন্নতা কোনো সীমাবদ্ধতা নয় বরং মানবতার বৈচিত্র্য। একেকটি ছোট্ট সহায়তা সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুদের জীবনকে করে তুলতে পারে সহজতর।
খাদিজাতুল জান্নাত : শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, বি.এস.সি ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিভাগ, বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনস ইনস্টিটিউট
[email protected]