যিশুর জন্মদিন ও বড়দিনের গুরুত্ব

আজ ২৫ ডিসেম্বর। সারা বিশ্বে মহাসমারোহে প্রভু যিশুর জন্মদিন পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা মানে খ্রিষ্টানরাও মহা-আনন্দে এই বড়দিন, ক্রিসমাস পালন করি।
আজ থেকে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ পূর্বে ঈশ্বর তনয় যিশুখ্রিষ্ট ঐশী শক্তিতে মেরির গর্ভে বেথলেহেমের জীর্ণ গোশালায় জন্মগ্রহণ করেছেন। এই মহামানবের জন্ম হয় অতি নীরবে, নিঃশব্দে ও বিনম্রতায়। বাণী প্রচারের সাথে সাথেই চারিদিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
অনেক লোক তাঁর অমৃতময় বাণী শোনার জন্য তাঁর চারপাশে ভিড় জমায়। শ্রোতাদের তিনি মন পরিবর্তনের আহ্বান জানান। পাপ, অসত্য, অন্যায় থেকে মন ফিরিয়ে সত্য, সুন্দর ও ভালো কাজে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান।
তাঁর শিক্ষা ছিল ভিন্নধর্মী, বাস্তবমুখী, গভীর, সহজ-সরল ও আকর্ষণীয়। তিনি শিক্ষা দিতেন গল্প, উপমা, প্রকৃতির বিভিন্ন সময়, ঋতু, ভূ-প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। সাধারণ মানুষ তাঁর কথা বুঝতে সহজেই বুঝতে পারতো।
তিনি শিক্ষা দেন আমরা যাতে পাপকে ঘৃণা করি, পাপীকে নয়। তিনি অবহেলিত, নির্যাতিত নিপীড়িত ও অস্পৃশ্যদের পক্ষ অবলম্বন করেন। তিনি বলতেন যে, অসুস্থদেরই ডাক্তার প্রয়োজন সুস্থদের জন্য নয়।
পৃথিবীতে থাকাকালীন অবস্থাতে তিনি অনেক আশ্চর্য কাজ করেছেন, অন্ধকে দিয়েছেন দৃষ্টি, কালাকে দিয়েছেন শোনার ক্ষমতা, প্রতিবন্ধীকে দিয়েছেন হাঁটার শক্তি, এমনই মৃতকে দিয়েছেন জীবন। তিনি অন্যকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে শিক্ষা দেন। শুধু পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুদেরই নয় এমনকি শক্রদেরও তিনি ভালোবাসতে বলেন। তিনি অপরকে ক্ষমা করার শিক্ষা দেন।
তিনি বলেছেন যে, সেবা পেতে নয় সেবা করতে এ জগতে এসেছেন। অন্যকে সেবা করার মধ্য দিয়েই আমরা মুক্তি এবং পরিত্রাণ লাভ করি। প্রতিবেশী ভাইবোনদের, বিশেষ করে ক্ষুধার্তকে অন্ন দান, তৃষ্ণার্তকে জল, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র, অসুস্থের সেবা করি, অসহায় ও গরিব দুঃখী মানুষদের যখন আমরা সেবা করি তখন তিনিই সেই সেবা গ্রহণ করেন।
...তিনি অন্যকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে শিক্ষা দেন। শুধু পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুদেরই নয় এমনকি শক্রদেরও তিনি ভালোবাসতে বলেন। তিনি অপরকে ক্ষমা করার শিক্ষা দেন।
তাঁর কাছে ব্যক্তির স্থান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে কারণ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সে সৃষ্ট। তাই তো তিনি ধর্মের ঊর্ধ্বে তাকে স্থান দিয়েছেন। ধর্মের জন্য মানুষ নয় বরং মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য ধর্ম।
আমরা এমন একজন মহান ব্যক্তির জন্মতিথি পালন করছি, যিনি শিশুদের ওপর শিক্ষার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শিশুরা আমাদের পরিবার ও সমাজে নতুন জীবন এবং আনন্দ বয়ে আনে। সন্তানের মধ্য দিয়ে জীবন প্রবাহিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে।
তৎকালীন সময়ে সমাজে শিশুদের স্থান ছিল না। অনেক সময়ে তাদের গণনায় ধরা হতো না।
একবার কয়েকজন মায়েরা তাদের শিশুদের যিশুর কাছে আনতে চাচ্ছিল যাতে তিনি তাদের আশীর্বাদ করতে পারেন। কিন্তু ভিড়ের জন্য তা করতে পারছিলেন না। যিশু তা দেখে বললেন, শিশুদের আমার কাছে আসতে দাও। যিশু তখন একটি শিশুকে আশীর্বাদ করলেন এবং সবার কাছে উঁচু করে দেখিয়ে বললেন, আমরা যদি শিশুটির মতো সহজ-সরল না হই তা হলে আমরা স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবো না। [লুক ১৮:১৫-১৭]
আরও পড়ুন
তিনি যেন শিশুদের আমাদের পরিবার ও সমাজের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। তাদের সহজ ও সরলতা বড়দের অনুকরণীয় এবং ঈশ্বর আমাদের কাছ থেকে তাদের মতোই নিঃস্বার্থ, আন্তরিক, সহজ-সরল ও নির্মল হৃদয়ের অধিকারী হওয়ার জন্য আমাদের কাছে আবেদন করেন।
যিশুর শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভালোবাসা। আমাদের জীবনটা মূল্যায়ন করতে হবে নিঃস্বার্থ ভালবাসার মানদণ্ডে। ভালোবাসাই মানুষের কাজ ও জীবনকে সার্থকতা ও পূর্ণতা দান করে।
তিনি বলেন যে, ‘ঈশ্বর জগৎকে এতই ভালোবেসেছেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে দান করে দিয়েছেন, ...ঈশ্বর জগতকে দণ্ডিত করতে তাঁর পুত্রকে এই জগতে পাঠাননি; পাঠিয়েছিলেন, যাতে তাঁর মাধ্যমে জগৎ পরিত্রাণ পায়।’ [যোহন ৩:১৭]
এই ভালোবাসা হলো সর্বজনীন। শুধু আপন-আত্মীয় ও প্রতিবেশীকে ভালোবাসলেই চলবে না, যিশু বলেন, ‘আমি তোমাদের বলছি, তোমরা তোমাদের শত্রুকে ভালোবাস; যারা তোমাদের নির্যাতন করে, তাদের মঙ্গল প্রার্থনা কর। এভাবেই তোমরা স্বর্গে বিরাজমান তোমাদের পিতার প্রকৃত সন্তান হয়ে উঠবে। কারণ সৎ-অসৎ সকলেরই জন্য তিনি ফুটিয়ে তোলেন তাঁর সূর্যের আলো, আর ধার্মিক-অধার্মিক সকলেরই ওপর তিনি নামিয়ে আনেন বৃষ্টির ধারা।’ [মথি ৬:৪৪-৪৫]
শাস্ত্রীদের ও ফরাসিদের উদ্দেশ্যে তিনি একজন পাপিষ্ঠ নারীকে দেখিয়ে বলেছিলেন, যে বেশি ভালোবাসে, ঈশ্বর তাকেই বেশি ক্ষমা করেন। তিনি ক্রুশের ওপর মৃত্যুর চরম যন্ত্রণার মুহূর্তেও তাঁর শত্রুদের ক্ষমা করেছিলেন।
যিশু আমাদের শিক্ষা দেন যেন আমরা একে অপরকে ক্ষমা করি। প্রতিনিয়ত আমরা ভুল করি। যদি আমরা ক্ষমা না পাই তাহলে আমাদের হৃদয়ে শান্তি পাই না। অস্থির হয়ে ওঠে আমাদের দেহ মন। তাই একবার না বারবার তিনি ক্ষমা করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, “যদি কেউ দিনে সাত সাতবার তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করে, আর সাত সাতবার তোমার কাছে এসে বলে, ‘আমার অন্যায় হয়েছে’। তাহলে তুমি তাকে অবশ্যই ক্ষমা ক’রো।” [লুক ১৭:৪]
ক্ষমা দেওয়া ও নেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা অন্তরে শান্তি অনুভব করি এবং মানব সমাজে স্থাপিত মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে।
একবার কয়েকজন শাস্ত্রী এবং ফরাসিরা তাঁর কাছে এক ব্যভিচারিণী নারীকে নিয়ে এসেছিলেন, যেন যিশু তার বিচার করতে পারেন। ইহুদিদের নিয়ম অনুসারে ব্যভিচারিণীকে পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকার করতে হবে। সবাই অনেক আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিল, যিশু যিনি ন্যায্যতার কথা বলেন এবং ক্ষমার কথাও বলেন তিনি এখন কী করবেন। অনেক লোক জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছিল কী করবেন তিনি তা দেখার জন্য। যিশু বললেন, তোমাদের মধ্যে যে পাপ করেনি সে আগে পাথর ছুঁড়ে মারুক। যিশু মাথা নিচু কী যেন লিখছিলেন। মাথা উঁচু করে ওই নারী ছাড়া তিনি আর কাউকে দেখতে পেলেন না। তিনি নারীকে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ কি তোমাকে দণ্ডিত করল না? সে উত্তর দিলো, না, কেউই করল না, প্রভু! যিশু তখন বললেন, আমিও তোমাকে দণ্ডিত করছি না! এখন যাও, তবে আর কখনো পাপ করো না তুমি। [যোহন ৮:১-১১]
যিশুর শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভালোবাসা। আমাদের জীবনটা মূল্যায়ন করতে হবে নিঃস্বার্থ ভালবাসার মানদণ্ডে। ভালোবাসাই মানুষের কাজ ও জীবনকে সার্থকতা ও পূর্ণতা দান করে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তারা শুধু নারীকে ধরে এনেছিল শান্তির জন্যে। যিশু আজীবন ভালোবাসা ও ক্ষমার কথা বলেছিলেন কিন্তু পাপীর মন পরিবর্তনের জন্য তিনি সবসময়ই আবেদন করেছেন, ক্ষমা পেয়ে যাতে আবার নতুন জীবন শুরু করার আরও একটা সুযোগ পায় কারণ তিনি এসেছিলেন জীবন দিতে।
পরিশেষে বলতে চাই, যিশু এ জগতে এসেছিলেন সেবা করতে, সেবা পেতে নয়। তিনি সেবার সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইলেন, ভালোবাসার চূড়ান্ত প্রমাণ দিতে চাইলেন। যদিও তাঁর প্রধান শিষ্য এতে বাঁধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। যিশু তার নিষেধ মানেননি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি একটি পাত্রে জল ঢেলে তাঁর শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমি তোমাদের প্রতি যা করলাম তোমরাও একে অপরের প্রতি তাই করবে। [যোহন ১৩:১-১২]
এই মহামানবের জন্মতিথিতে আমি সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। বড়দিন প্রত্যেকের জীবনে বয়ে অনাবিল সুখ, শান্তি ও আনন্দ। শুভ বড়দিন।
বিজয় এন. ডি’ক্রুজ, ওএমআই : আর্চবিশপ, ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ
