আজীবন মহানবী (সা.) এর পরিবারের সঙ্গে ছিলেন যে নারী সাহাবি

রাসূল সা.-এর আযাদকৃত দাসী ছিলেন উম্মু আয়মান রা.। তাঁর ভালো নাম বারাকা। তিনি ছিলেন হাবশী নারী। পিতার নাম সালাবা ইবনে আমর। তিনি রাসূল সা.-এর বাবা আব্দুল্লাহ ও মা আমিনার দাসী ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে রাসূল সা. তাকে দাসী হিসেবে গ্রহণ করেন।
খাদিজা রা.-এর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর রাসূল সা. তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। তিনি রাসূল সা.-এর ধাত্রী ছিলেন। শৈশব থেকে মুত্যুর পর পর্যন্ত রাসূল সা.-এর সঙ্গে ছিলেন তিনি। একমাত্র সাহাবি যিনি আজীবন রাসূল সা.-এর পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
রাসূল সা.-কে কোলে-কাঁখে করে যারা বড় করেছেন তিনি তাদের একজন। রাসূল সা. এর সাতটি ছাগী ছিল, উম্মু আয়মান সেগুলো চরাতেন।
ছয় বছর বয়সে রাসূল সা. যখন মা আমিনার সঙ্গে মদিনায় যান তখন উম্মু আয়মানও সঙ্গে ছিলেন।
ইয়াসরিবের অধিবাসী উবাইদ ইবনে আমর আল খাজরাজী তাকে বিয়ে করে ইয়াসরিবে নিয়ে যান। আয়মান নামে তাদের এক ছেলে জন্মগ্রহণ করে। কিছুদিন পর উবাইদ মারা যান। এরপর উম্মু আয়মান আবার মক্কায় মুহাম্মদ সা.-এর পরিবারে ফিরে আসেন।
এরপর দীর্ঘদিন তিনি রাসূল সা.-এর পরিবারে বিধবা হিসেবে কাটিয়ে দেন। রাসূল সা. একদিন মক্কায় সাহাবিদের বললেন—
তোমাদের কেউ যদি জান্নাতের অধিকারীণী কোনো নারীকে বিয়ে করতে চায় সে যেন উম্মু আয়মানকে বিয়ে করে।
এই ঘোষণার পর রাসূল সা.-এর পালকপুত্র ও প্রিয়ভাজন যায়দ বিন হারিসা রা. তাকে বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেন। রাসূল সা. নিজে উদ্যোগী হয়ে তাদের দুজনের বিয়ে দিন। তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত সেনানায়ক উসামা (রা.)।
তবে তিনি প্রথম স্বামীর ঘরের সন্তান আয়মানের নাম অনুসারে আরবের রীতি অনুযায়ী উম্মু আয়মান উপনাম গ্রহণ করেন এবং এ নামেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। উম্মু আয়মান হুনাইন যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।
আরও পড়ুন
উম্মু আয়মান (রা.) ইসলামের প্রথম পর্বেই মুসলমান হন। তিনি হাবশা এবং মদিনা উভয় স্থানেই হিজরতের গৌরব অর্জন করেন। তিনি স্বামী যায়দ ইবনে হারিসার সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন।
উম্মু আয়মান রা. উহুদ ও খায়বার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উহুদে সৈনিকদের পানি পান করানো ও আহতদের সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
উহুদ যুদ্ধে তিনি আনসার নারীদের সঙ্গে মুসলিম মুজাহিদদের পানি করা করাচ্ছিলেন। এ সময় হিব্বান ইবনে আরাকা তাকে লক্ষ্য করে একটি তীর নিক্ষেপ করে। তীরটি তার কাপড়ের ঝালরে লাগে এবং তার দেহের কিছু অংশ বেরিয়ে পড়ে। তা দেখে তীর নিক্ষেপকারী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
রাসূল সা. সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাসের হাতে একটি তীর ধরিয়ে দিয়ে বলেন, এটি মারো। সাদ তীরটি ছুড়ে মারলেন। তা হিব্বানের গায়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং মারা যায়। তা দেখে রাসূল সা. এমনভাবে হেসে দেন যে তার দাঁত দেখা যায়।
আল হারিস ইবনে হাতিব, ছালাবা ইবনে হাতিব, সাওয়াদ ইবনে গাযিয়্যা, সাদ ইবনে উসমান ও আরও কয়েকজন উহুদের ময়দান থেকে পালিয়ে আসেন। তা দেখে উম্মু আয়মান তাদের তিরস্কার করে বলেন, যাও ঘরে চরকা আছে, সুতা কাটো।
হজরত উম্মু আয়মান রা. আজীবন রাসূল সা.-এর পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাসূল সা.-এর পরিবারের সঙ্গেই তিনি মদিনায় হিজরত করেন। হজরত আলী ও ফাতিমা রা.-এর বিয়ের সময়ও তিনি সবার অগ্রভাগে ছিলেন। নতুন কনের সঙ্গে তিনিও ফাতিমা রা.-এর বাড়িতে যান এবং রাতে সেখানে অবস্থান করেন। হজরত খাদিজা রা., রাসূল সা.-এর মেয়ে যায়নাব রা., এবং রুকাইয়া রা. এর ইন্তিকালের পর তাদের গোসল করান উম্মু আয়মান রা.।
রাসূল সা. উম্মু আয়মানকে যথেষ্ট সমাদর ও সম্মান করতেন। মাঝেমধ্যে মা বলেও সম্বোধন করতেন। তিনি তাকে নিজের পরিবারের অবশিষ্ট অংশ বলতেন। উম্মু আয়মান রা. খুব সহজ-সরল ছিলেন। রাসূল সা. তার সঙ্গে মাঝে মাঝে রসিকতা করতেন।
রাসূল সা.-এর ইন্তিকালের সময় উম্মু আয়মান অনেক কান্না করেন। লোকেরা তাকে বললেন, আপনি এতো কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, আজ থেকে অমাদের কাছে আসমান থেকে ওহী আসা বন্ধ হয়ে গেল, তাই কাঁদছি। হজরত ওমর রা.-এর ইন্তিকালের সময়ও তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আজ থেকে ইসলাম দুর্বল হয়ে গেল।
উম্মু আয়মান রাসূল সা.-এর কাছ থেকে শোনা পাঁচটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান রা.-এর সময়ে ইন্তিকাল করেন।
(আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ৬/৯২)