স্টেডিয়ামে ভাঙচুরের নেপথ্যে দুই মন্ত্রীর মেসির ‘দখল’ নেওয়ার লড়াই

তিন দিনের সফরে ভারতে এসে শুরুতেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েন লিওনেল মেসি। সফরের প্রথম দিনেই কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে চরম অব্যবস্থাপনায় ঠিকমতো তার দেখাই পাননি গ্যালারিভর্তি দর্শকরা। ক্ষুব্ধ হয়ে তারা স্টেডিয়ামের আসন ভাঙচুর, আগুন দেওয়ার চেষ্টাসহ মাঠে ঢুকে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। তাদের ক্ষোভের মুখে অনুষ্ঠানের আয়োজক শতদ্রু দত্তকে আটক করেছে কলকাতা পুলিশ। আর এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তার ফল কী আসবে, তার জন্য আপাতত অপেক্ষা করতে হবে। তবে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যম এই ঘটনার সূত্রপাত খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। তারা বলছে, দুই মন্ত্রীর মেসির ‘দখল’ নেওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে এই বিশৃঙ্খলা। এছাড়া ভিআইপিদের মেসিকে ঘিরে রাখাও ছিল দর্শকদের তাকে দেখতে না পাওয়ার অন্যতম কারণ।
মেসিকে ভালোভাবে দেখার জন্য সল্টলেক বা যুব ভারতী স্টেডিয়ামে অপেক্ষায় ছিলেন হাজারো ভক্ত-সমর্থক। সেখানে একটি প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল। সফরের প্রথম দিন ঠিক সকাল সাড়ে ১১টায় যুবভারতীর মাঠে ঢোকে মেসির গাড়ি। তবে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মানুষ তাকে ঘিরে জটলা তৈরি করেন। মেসি স্টেডিয়ামে পৌঁছাতেই অন্তত ৭০-৮০ জন মানুষের ভিড় ঘিরে ধরে তাকে, যাদের মধ্যে অধিকাংশ মূলত মন্ত্রী, কর্তারা। ভালোভাবে হাঁটতেও পারছিলেন না আটবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী! ক্যামেরা ও মোবাইল হাতে তার সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা।
এ ছাড়া নিরাপত্তারক্ষীদের বেষ্টনী তো ছিলই। গ্যালারি থেকে তাকে দেখা যাচ্ছিল না। চড়া দামে টিকিট কেটে মেসিকে দেখতে যাওয়া ফুটবলপ্রেমীদের শেষ ভরসা ছিল স্টেডিয়ামের তিনটি জায়ান্ট স্ক্রিন। কিন্তু তাও দেখা যায়নি। মোহনবাগান এবং ডায়মন্ড হারবারের প্রাক্তন ফুটবলারদের সঙ্গে মেসি পরিচিত হওয়ার সময়ও প্রচণ্ড ভিড় ছিল তাকে ঘিরে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং প্রধান আয়োজক শতদ্রু দত্তকে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করতে হয়। তাতেও স্বাভাবিক হয়নি পরিস্থিতি। পরবর্তীতে ১১.৫২ মিনিটে মাঠ ছেড়ে যান মেসি। এরপরই শুরু হয় বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি।

কলকাতার সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, দুই মন্ত্রীর মেসিকে দখলে নেওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে গোলমালের সূত্রপাত। এই দুজন হলেন পশ্চিমবঙ্গের দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু ও ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
শুক্রবার দিবাগত রাতে কলকাতায় এসে পৌঁছান মেসি। আনন্দবাজার লিখেছে, তিনি কলকাতা বিমানবন্দরে পা রাখার পরই তাকে নিজের ‘দখলে’ নেন সুজিত। হোটেল হায়াত রিজেন্সিতে উঠেছিলেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। সেখানে মেসিকে ঘিরে ছিলেন দমকলমন্ত্রীর লোকজন। তার অপেক্ষায় সেই হোটেলে সুজিত সপরিবারে ছিলেন। দমকলমন্ত্রীর ক্লাব শ্রীভূমির সামনে ৭০ ফুটের মূর্তি উন্মোচন করা থেকে মেসির সঙ্গে সার্বক্ষণিক ছিলেন সুজিত। মঞ্চে তার মেয়েকেও হাজির করেন তিনি।
মেসি মাঠে ঢুকতে তার দখল হারান সুজিত। স্টেডিয়ামে তার ওপর প্রভাব ফেলেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড মাঠে ঢোকার পর তাকে নিজ লোকদের নিয়ে ঘিরে ফেলেন তিনি। মেসির সঙ্গে ছবি তুলতে তাকে নিয়ে টানাহ্যাচড়া শুরু করেন এই মন্ত্রী। আশপাশে আরও ছিলেন কলকাতার মাঠের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা, ফুটবলার ও টালিউডের পরিচিত মুখেরা। এত ভিড়ের মধ্যে মেসিও অস্বস্তিতে ছিলেন। একবার তো নিরাপত্তা কর্মী অরুপের ঘেষাঘেষি বন্ধ করতে তাকে সরিয়ে দেন। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে থাকার কথা থাকলেও ২২ মিনিট যেতেই মাঠ ছাড়েন মেসি। এই পুরোটা সময়ে তাকে ঘিরে ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রীর লোকজন। তাদের কারণে হাজার হাজার টাকা খরচ করে মেসিকে দেখতে আসা জনতার হৃদয় ভেঙে যায়। যা পরিণত হয় ক্ষোভে।
ভারতের আরেকটি সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ভিআইপি সংস্কৃতি। মেসি মাঠে আসতেই কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত অতিথি ও আলোকচিত্রী তাকে ঘিরে ধরেন। এমন পরিস্থিতিতে নিজেরই চলতে অসুবিধা হয়েছে তার, তারপর গ্যালারিতে থাকা দর্শকদের দিকে মনোযোগ দেওয়া ছিল খুবই কঠিন।
এনডিটিভি লিখেছে, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মেসির চারপাশে ঘিরে ছিলেন একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ। যে কারণে গ্যালারিতে থাকা দর্শকেরা তার দর্শন পাননি।
এফএইচএম/