গত কয়েকদিন ধরেই দেশের এভিয়েশন খাতে আলোচিত ইস্যু বাংলাদেশ বিমানের পাইলটদের হুঁশিয়ারি। অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেতন ভাতা সমন্বয় এবং বেতন কর্তনের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ৩০ জুলাইয়ের পর আবুধাবি, দুবাই, দোহা, দাম্মাম রুটে ফ্লাইট না চালানোর আল্টিমেটাম দিয়ে রেখেছেন তারা।  

বাংলাদেশ বিমানের পাইলটরা বলছেন, তারা বৈষম্যের শিকার। তবে তাদের এই দাবি মানতে নারাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। বিমান বলছে, করোনা মহামারিতে পাইলটদের ছাঁটাই না করাটাই ছিল বিমানের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। পাইলটদের স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করার তাগিদ দিচ্ছে তারা। 

চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ বিমানে কর্মরতদের বেতন কাটার একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ১৩ জুলাই বিমানের পরিচালক (প্রশাসন) জিয়াউদ্দীন আহমেদের একটি অফিস আদেশে পাইলট ছাড়া বিমানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কর্তনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। এ সিদ্ধান্তের পরই পাইলটদের ক্ষোভের বিষয়টি সামনে আসে। তারা বেতন বৈষম্যের প্রতিবাদ জানান এবং ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে বেতন সমন্বয়ের আহ্বান জানান এবং তা না হলে বাংলাদেশ বিমান ও পাইলটদের মাঝে হওয়া দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বাইরে পাইলটরা ফ্লাইট পরিচালনা করবেন না বলে জানান।  

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বলছে, অধিকাংশ পাইলটের বেতন ইতোমধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে। কিছু সংখ্যক পাইলটের বেতন কর্তন করা হবে। করোনা সংকট উত্তরণ পর্যন্ত এভাবেই খরচ বাঁচাতে চায় এয়ারলাইন্সটি।

বিমানের পাইলটদের বেতন কত? অন্য এয়ারলাইন্সে কত?
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকা পোস্টকে জানায়, বর্তমানে এশিয়ার সর্বোচ্চ ও মধ্যপ্রাচ্যের বড় বড় এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলটদের বেতন সর্বোচ্চ।  

বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানে মোট ১৫৯ জন পাইলট রয়েছেন। তাদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স শূন্য থেকে ৫ বছর তারা (স্বাভাবিক সময়ে) মাসে ২ লাখ ৬ হাজার টাকা বেতন পান। যাদের চাকরির বয়স ৫ থেকে ১০ বছর ওভারসিজ অ্যালাউন্সসহ তারা পান মাসে ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত চাকরিরতরা মাসে ১০ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং যাদের চাকরির বয়স ২০ বছরের বেশি তারা মাসে ১২ লাখ ১ হাজার টাকা বেতন পান। এছাড়াও বোয়িং-৭৭৭ পরিচালনার জন্য বিমানের চুক্তিভিত্তিক পাইলটদের বেতন মাসে সাড়ে ৬ লাখ টাকা।

ভারতের স্পাইসজেটের একজন পাইলটের সর্বোচ্চ বেতন ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ইন্দোনেশিয়ার গারুদা এয়ারলাইন্সের পাইলটের বেতন ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা, উইংস এয়ারের পাইলটের বেতন ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বিশ্বের অন্যতম দু’টি বৃহৎ এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান ইতিহাদ এবং তার্কিশ এয়ারলাইন্সের পাইলটদের বেতনও বিমানের পাইলটদের সর্বোচ্চ বেতনের কম। স্বাভাবিক সময় ইতিহাদ তাদের পাইলটদের সর্বোচ্চ ৮ লাখ ৮১ হাজার এবং তার্কিশ এয়ার ১১ লাখ টাকা বেতন দেয়।

বেতনের বিষয়টি ছাড়াও বাংলাদেশ বিমান বলছে, করোনা মহামারিতে পাইলটদের ছাঁটাই না করাটা ছিল বিমানের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান এয়ারলাইন্স তাদের ১৩ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে, এর মধ্যে ১৮০০ পাইলট এবং ৪ হাজার ২০০ জন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট রয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রতিষ্ঠান ডেলটা এয়ারলাইন্স দুই হাজার, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ১২ হাজার কর্মী, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান এমিরেটস ৪৫০০ পাইলটের মধ্যে ১২০০ জনকে চাকরিচ্যুত করেছে করোনা মহামারি শুরুর পর। ভার্জিন আটলান্টির এয়ারওয়েএজ ৩ হাজার কর্মী, রিয়ান এয়ার ৩ হাজার, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এয়ারলাইন্স ৫ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। এছাড়াও এয়ারক্রাফট তৈরির প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে করোনাকালে।

সিঙ্গাপুরে করোনা মোকাবেলায় সব ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলেও দেশটিতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ছাঁটাই হয়েছে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে। প্রতিষ্ঠানটিতে ৪৩০০ কর্মীকে একযোগে ছাঁটাই করা হয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বলছে, কোভিড-১৯ এর কারণে এয়ারলাইন্স ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার কারণে সারা বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারলাইন্স যেখানে তার কর্মী ও পাইলটদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বা বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠিয়েছে, সেখানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মরত কর্মী ও পাইলটদের কাউকে চাকরি থেকে অব্যাহতি বা বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠায়নি। বরং সবার মঙ্গল চিন্তা করে ব্যয় সংকোচন করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছে। এর জন্য অন্যান্য আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের মতোই বিভিন্ন গ্রেডে বিভিন্ন হারে বেতন কর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সবার কর্তনকৃত বেতন পর্যায়ক্রমে স্বাভাবিক সময়ের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিমানের এই বেহাল দশায় পাইলটদের বেতনের কিছু অংশ কর্তনে তাদের এমন আচরণ অত্যন্ত দুঃখজনক।

বিমান কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোর্ড অব ডিরেক্টরের মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমানে ফ্লাইং ঘণ্টার হিসাব অনুযায়ী ওভারসিজ অ্যালাউন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়াও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে উল্লেখিত সাপ্তাহিক ফ্লাইং ঘণ্টার অতিরিক্ত উড্ডয়নের জন্য প্রোডাক্টিভিটি অ্যালাউন্স পান পাইলটরা।

বেতন কর্তনের পর পাইলটরা কত টাকা পাবেন?
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ম্যানেজমেন্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পাইলটদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স ০-৫ বছর, তারা জুলাই মাসে পুরো বেতন অর্থাৎ ২ লাখ ৬ হাজার টাকা বেতন পাবেন। এমন পাইলটের সংখ্যা বিমানে ৬৯ জন। যাদের চাকরির বয়স ৫-১০ বছর, তারা ৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা পাবেন। পাশাপাশি ফ্লাইং ঘণ্টার হিসাব অনুযায়ী ওভারসিজ অ্যালাউন্স পাবেন।

যাদের চাকরির বয়স ১০-২০ বছরের মধ্যে তারা ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং ফ্লাইং ঘণ্টার হিসাব অনুযায়ী ওভারসিজ অ্যালাউন্স পাবেন। আর যাদের চাকরির বয়স ২০ বছরের বেশি ৭৫% হিসেবে তারা পাবেন ৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকার মতো। আর বিমানের পরিচালনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্লাইং ঘণ্টার হিসাব অনুযায়ী ওভারসিজ অ্যালাউন্স পাবেন।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলটদের সংগঠন বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমান যে বেতন কাঠামোর কথা বলেছে সেটা সঠিক না। বেতন কাঠামোর বিষয়ে বাপার কেউ কিছু জানেও না। এছাড়াও ওভারসিজ ভাতা বেতনের অংশ। বাপার সাথে আলোচনা না করে এটা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে পাইলটদের আন্দোলনে দাম্মাম,দোহা, আবুধাবি ও দুবাই রুটে ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় সেই সব রুটে টিকিট ফেরত দেওয়ার হিড়িক পড়েছে।  

বিমানের এমডি আবু সালেহ মোস্তফা কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমানে পাইলটদের আন্দোলনের সংবাদে গত ৪৮ ঘণ্টায় মোট ৭ কোটি টাকার টিকিট ক্যান্সেল (ফেরত) হয়েছে। পাইলটদের আল্টিমেটামের সংবাদে আমরা যাত্রীদের বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ করছি। পাইলটরা এখনও আন্দোলনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাননি। এছাড়াও কোন কোন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে না এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিমানকে কোনো আল্টিমেটাম দেওয়া হয়নি। তারা শুধুমাত্র আমাদের বেতন সমন্বয়ের বিষয়গুলো অবগত করেছেন।

এআর/এনএফ