রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগ সিট বরাদ্দ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে শূন্য আসনে বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও ছাত্রলীগই যেন সর্বেসর্বা। এমনকি আসন প্রতি ৯-১১ হাজার টাকা করে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। 

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সিটের বিনিময়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ, হল প্রাধ্যক্ষের মাধ্যমে আবাসিকতা পাওয়া বৈধ শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়া, সিট দখলে নিতে রুমে তালা লাগিয়ে দেওয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে ঢাকা পোস্ট। দীর্ঘ দুই মাসের অনুসন্ধানে শতাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে হলে সিট বাণিজ্যের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সিট বাণিজ্য ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও মুখ খুলতে রাজি নন টাকা দিয়ে ওঠা শিক্ষার্থীরা। এমনকি প্রকাশ করা হলে শারীরিক নির্যাতন ও সিট বাতিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের। 

এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. রাসেল ও একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর কথোপকথনের অডিও রেকর্ড হাতে পান এই প্রতিবেদক। কথোপকথনে টাকার জন্য নিজের আসল চেহারা দেখানোর হুমকিও দিতে শোনা যায় তাকে। যেখানে সিটের জন্য ৪ হাজার টাকার পর আরও টাকার জন্য দরকষাকষি করছিলেন তিনি। 

কথোপকথনের বিষয়ে সহ-সভাপতি মো. রাসেল বলেন, ‘আপনি ওকে জিজ্ঞেস করেন, সে কি আমাকে টাকা দিছে? না। কিন্তু টাকা পাওয়ার পর নিশ্চিত হতে ফোন দেওয়া অন্য একটি রেকর্ডে তাকে নিশ্চিত করতে শোনা যায়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আপনি রেকর্ডে শুনলেও ওটা মিথ্যা। আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, সে আমাকে টাকা দিছে কি না?’ 

তবে আরেক সহ-সভাপতি গোলাম সারোয়ার ৩ হাজার এবং আপনি এক হাজার টাকা নিয়েছেন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি যদি এক হাজার টাকা নিয়েও থাকি সেটা আমার বন্ধু সারোয়ারের থেকে। এগুলো আলাদা বিষয়।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত আরেক সহ-সভাপতি গোলাম সারোয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘না না না। কে সেই শিক্ষার্থী? নাম কি তার? কোন হলের সেটা? এটা মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। রাসেলই বলতে পারবে ভালো। রাসেল বলেছে এ কথা? আমি ২০১৬ সালের পর থেকে হলে শিক্ষার্থী উঠানো ছেড়ে দিছি।’

অনুসন্ধানে সিট বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন হলের বেশ কিছু  দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে। 

জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে হল রয়েছে ১৭টি। এর মধ্যে ছেলেদের জন্য ১১টি এবং মেয়েদের জন্য ৬টি রয়েছে। করোনায় বন্ধের কারণে হল ভেদে গড়ে ১০০-১৭০টি আসন খালি হয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ১০০টি শেরে-বাংলা হলে এবং সর্বোচ্চ ১৯৩টি সোহরাওয়ার্দী হলে খালি হয়। করোনা পরবর্তী সময়ে হলগুলোতে শত আসন ফাঁকা থাকলেও শুধু শহীদ জিয়াউর রহমান ও শহীদ শামসুজ্জোহা হল ছাড়া অন্য হলে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। 

এর মধ্যে শহীদ জিয়াউর রহমান হলে ১৯৬টি (ক্যাম্পাস খোলার পর ফাঁকা আসন বেড়েছে) ফাঁকা আসনের বিপরীতে বরাদ্দ দিয়েও ২৫-৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে উঠাতে পারেনি প্রশাসন। এসব সিটে আগে থেকেই অবৈধভাবে শিক্ষার্থী উঠিয়ে রেখেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসব আসনে বৈধভাবে আবাসিক ছাত্রদের উঠাতে গেলে হল প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামতে দেখা যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। 

ফাঁকা আসনের তথ্য সংগ্রহ করে ছাত্রলীগ 

কখন কোন সিট ফাঁকা হচ্ছে? জানতে ছেলেদের ১১টা আবাসিক হলের প্রতিটি ব্লকের রুমে রুমে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকর্মীরা। তথ্য সংগ্রহ করার এ কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রুম ভিজিট’। কার কবে মাস্টার্স শেষ হবে, কবে নাগাদ সিট ফাঁকা হবে, আবাসিকতা আছে কি না সে-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে ছাত্রলীগ। সেই তথ্য ধরে নিয়ন্ত্রণ করা হয় কোন সিটে কখন কে নামবে বা উঠবে। 

আসনের দাম নির্ধারণ করে ছাত্রলীগ

ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথোপকথনের বেশ কিছু অডিও রেকর্ড পেয়েছে ঢাকা পোস্ট। এসব রেকর্ডের সূত্র ধরে জানা গেছে, হলের অবস্থান ও রুমে আসন সংখ্যার ওপর নির্ভর করে দাম। 

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কিছু সূত্রে জানা গেছে, হল ও রুমের ওপর ভিত্তি করে নির্ভর করে কত টাকায় বিক্রি হবে আসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে সিঙ্গেল রুমের দাম ৯-১১ হাজার টাকা, ৪ জনের ৬-৮ হাজার টাকা, শহীদ জিয়াউর রহমান হলে ২ জনের রুমে ৬-৭ হাজার আর ৪ জনের আসনে ৪-৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। 

আমির আলী, শাহ মাখ্দুম ও আব্দুল লতিফ হলে সিঙ্গেল, ২ সিটের ও ৩ সিটের রুমে আসন প্রতি দিতে হয় ৪-৬ হাজার টাকা। আবার আমীর আলী হলে বৈধভাবে আবাসিকতা প্রাপ্ত কোনো শিক্ষার্থী যদি এক রুম থেকে অন্য রুমে যেতে চায় সেজন্য গুনতে হয় ৫০০-১০০০ টাকা। জিয়া হলে সে অংক ১-২ হাজার টাকা। 

সিট বিক্রির দাম অনুযায়ী ১০০০-১৫০০ টাকা পান সাধারণ কর্মীরা। আর বাকি টাকা ভাগাভাগি হয় হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাদের মধ্যে। মূলত ২৪ জন নেতা ও সাধারণ কর্মী জড়িত আসন বাণিজ্যে। 

হাত বদলায় টাকা

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সূত্র ধরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সন্ধান মিলেছে। সেখানে দেখা যায়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের হয়ে কেন্দ্র থেকে চারজন সহ-সভাপতি নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো বাণিজ্য। তাদের মধ্যে সভাপতি অংশের দিক নিয়ন্ত্রণ করেন সহ-সভাপতি গোলাম সারওয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময় ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইমতিয়াজ আহমেদ। 

তবে তাদের মধ্যে গোলাম সারওয়ারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলেও বাকি দুইজনের নাম উল্লেখ করেননি শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যাচ্ছে, তারাও কর্মীদের মাধ্যমে বিভিন্ন হলে সিট বাণিজ্য করে থাকেন। আর সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর হয়ে কাজ করেন সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত, সহ-সভাপতি মো. রাসেল। 

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের এক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সব-কয়টা হলের সিট বাণিজ্যের মূল হোতা হলেন বৃত্ত দাদা। ক্যাম্পাস খোলার পর উনি একা ৬০ লাখ টাকার সিট বাণিজ্য করেছেন। উনার মাধ্যমে নেতারা কত টাকা পেয়েছেন সেটা আমি জানি না।’

সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্তের সিট বাণিজ্যের প্রমাণ মেলে ফাঁস হওয়া এক অডিও রেকর্ডে। সে কথোপকথনের সূত্র ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। একটি হলের ডাবল সিটের কক্ষ নিয়ে সিট বাণিজ্যের কথোপকথনের রেকর্ড প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। হলে সিট প্রত্যাশী এবং ছাত্রলীগ কর্মীর সেই কথোপকথনে স্পষ্ট হয়েছে পদহীন কর্মীদের দ্বারা সিট বাণিজ্য করেন বৃত্ত।

সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্যানেলের সহ-সভাপতি। সাধারণ সম্পাদকের দিক থেকে সিটের বিষয়গুলো দেখেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরাও আছি। আবার অন্য অনেকেই দেখে। প্রত্যেকটা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দেওয়া আছে।’ 

সিটের তালিকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আমাদের হাতে কেন থাকবে? আমাদের ভাই-ব্রাদারের রুম নম্বর আমরা জানি, বিভিন্ন কাজে যেতে হয় হলে। সিট বিক্রির মাধ্যমে ৬০ লাখ টাকা আয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি। তবে হল প্রভোস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সিটে তোলা হয় বলে স্বীকার করেছেন তিনি।

সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেনি। এ রকম কোনো অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ তবে রাসেলসহ অন্যান্য নেতাকর্মীদের সিট বাণিজ্যের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তার জানা নেই বলেন।

সার্বিক বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, সিট বাণিজ্যের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্সে অবস্থান নিয়েছি। নির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব। কিন্তু আগের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাইলে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি তিনি। তবে হল সম্মেলনে এ ধরনের অভিযোগগুলো মাথায় রেখে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা জানিয়েছেন তিনি। 

মেশকাত মিশু/এসপি