ফল প্রকাশে ‘জট’ কাটাতে পারছে না ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়
চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে করে বেশ ভোগান্তিতে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মাদরাসাগুলোর শিক্ষার্থীরা। বিধি অনুযায়ী চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তিন মাসের মধ্যেই ফল প্রকাশের কথা থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। পরীক্ষার পাঁচ মাস পেরুলেও মিলছে না ফল। এতে করে বাড়ছে সেশনজট। বিশেষ করে চার বছর মেয়াদি ফাজিল (স্নাতক) কোর্সের শিক্ষার্থীরা পড়ছেন বেশি বিপাকে।
তথ্য মতে, বর্তমানে সারাদেশে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন মাদরাসায় ফাজিল পাস কোর্স (২ বছর মেয়াদি), ফাজিল স্নাতক (৪ বছর মেয়াদি), কামিল পাস কোর্স ও কামিল স্নাতকোত্তর চালু রয়েছে। চার বছর মেয়াদি স্নাতকের বিষয়গুলো হলো- আল-কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য।
বিজ্ঞাপন
সারাদেশের মাদরাসাগুলোতে এসব বিষয়ে বর্তমানে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফাজিল অনার্স ১ম, ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ বর্ষ পরীক্ষা—২০২০ এর চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১ম, ২য়, ৩য় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে মার্চে ও ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা এপ্রিল মাসে শেষ হয়েছে। সে হিসেবে প্রায় পাঁচমাসেও ফল প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে ফাজিল অনার্স ১ম, ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ বর্ষ পরীক্ষা—২০১৯ এর চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলও দীর্ঘ ১১ মাস ২৬ দিন পর প্রকাশ করা হয়।
বিজ্ঞাপন
তাদের অভিযোগ, যথাসময়ে পরীক্ষা না হওয়া ও ফল প্রকাশে বিলম্বের কারণে স্নাতক শেষ করার সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার খবর নেই। তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলও তারা পাননি। আর করোনার কারণে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে একই শিক্ষাবর্ষে থাকতে হয়েছে ফাজিল (স্নাতক) ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থীদের। নিয়ম মতে, এসব শিক্ষার্থীদের চারবছর মেয়াদি স্নাতক কোর্স ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২২ সালে এখনও তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল দেওয়া হয়নি। এমন অবস্থায় শিক্ষা জীবনে দীর্ঘ সেশনজট নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা।
সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়ার ফাজিল (স্নাতক) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, বিধি অনুযায়ী পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তিন মাসের মধ্যেই রেজাল্ট দেওয়ার কথা। কিন্তু সবসময়ই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাওয়ার পর যে গতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল বর্তমানে সেটি অনেকটাই শ্লথ হয়ে পড়েছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে আমাদের জীবন এবং ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে। সেশনজট বাড়ছে। আমরা অনতিবিলম্বে এর প্রতিকার চাই। দ্রুত ফল প্রকাশ করে শিক্ষাবর্ষের যাবতীয় কার্যক্রম গতিশীল রাখতে হবে।
নেত্রকোণা এন আকন্দ কামিল মাদরাসার ফাজিল (স্নাতক) চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নওশিন চৌধুরী এলিন বলেন, স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়ায় বিভিন্ন সরকারি চাকরি পরীক্ষায় আমরা অংশগ্রহণ তো দূরে থাক আবেদনই করতে পারছি না। প্রতিটি বর্ষেই ফল নিয়ে এরকম সমস্যা হয়েছে। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসার ফাজিল কামিল দেওয়া হয়েছে দ্রুততার সঙ্গে সব কার্যক্রম শেষ করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে প্রায় কাজেই বিলম্ব হচ্ছে। আমরা এর প্রতিকার চাই৷ দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ফল প্রকাশের নিয়ম বাস্তবায়ন করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
হতাশ মাদ্রাসা প্রধানরাও!
ফল প্রকাশে দীর্ঘ সূত্রিতার ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেন মাদরাসা প্রধানরাও। সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়ার অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আবদুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আগেও কথা বলে কোনো প্রতিকার পাইনি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা অসহায়। আমার ছাত্র পরীক্ষা দেওয়ার পর এক বছরের মধ্যেও রেজাল্ট পায় না। আমরা বলার পর বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সদুত্তরও উত্তর দিতে পারেন না। এখানে আমাদের কি করার আছে।
দীর্ঘসূত্রিতা নিরসনে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল বাড়ানো প্রয়োজন উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আমিনুল ইসলাম বলেন, এই রেজাল্ট আরও অনেক আগেই দেওয়া যেত। আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল কার্যক্রমের ধীরতার কারণেই ফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। আমি নিজে প্রধান পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। অনেক ব্যস্ততার পরও আমার কাছে মূল্যায়নের জন্য পাঠানো পরীক্ষার খাতা দেখে ঠিক সময়ের মধ্যেই তাদের কাছে পৌঁছে দেই। তারপরও কেন দেরিতে ফল প্রকাশ করা হয় তা আমাদের জানা নেই।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও মূল্যায়নের জন্য খাতা দেরিতে পাঠানো হয়। ফলে এর প্রভাব পড়ে রেজাল্ট তৈরিতে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি আরও আন্তরিক হয় এবং তাদের জনবল বাড়ায় তবে এ সমস্যার সমাধান হবে, না হয় সংকট আরও বাড়বে।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নেই, অতিরিক্ত দায়িত্বে প্রো-ভিসি!
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সহকারী-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (অতি. দায়িত্ব) জিয়াউর রহমান জানান, সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম গাউসুল আজম এর পিআরএল জনিত অবসরের পর থেকে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পদটি ফাঁকা রয়েছে গত জুন মাস থেকে। নেই সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকও। বর্তমানে এই দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর থেকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পদটি শূন্য রয়েছে।
আমি এখন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সহকারী-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছি। আর মূল দায়িত্ব স্বয়ং প্রো-ভিসি স্যার নিজেই পালন করছেন। স্যার নিজেই সবকিছু দেখভাল করছেন। তাছাড়া ফল তৈরির কাজও প্রায় শেষের দিকে। খুব দ্রুতই প্রকাশ করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
মাদরাসা ও শিক্ষকদের ভুলে ফল তৈরিতে কালক্ষেপণ
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনার ফলে দীর্ঘ ছুটির পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে ও পুনরায় করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় পর পর তিনটি চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া হয়। সারাদেশের বিভিন্ন কেন্দ্র ও পরীক্ষকদের থেকে এসব পরীক্ষার ওএমআর শিট ডাকযোগে পাঠানোর সময় ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত নিয়ম মানা হয়নি। শ্রেণি ও শিক্ষাবর্ষের ভিন্নতা বজায় রাখতে ওএমআর পাঠানোর প্যাকেটের কাপড়ের রঙ না মানায় ঝামেলায় পড়তে হয়েছে ফল তৈরিতে। কেউ বিভিন্ন বর্ষের জন্য নির্ধারিত রঙের কাপড়ের প্যাকেটে ওএমআর পাঠিয়েছেন আবার কেউ তার অনুসরণ করেননি। ফলে ডাকযোগে পাঠানো এসব ওএমআর শিক্ষাবর্ষ ও কোর্স অনুযায়ী আলাদা করতেই কালক্ষেপণ হয়েছে।
ফল তৈরির নিরাপত্তা কাগজ সংকট
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এক ধরনের বিশেষ নিরাপত্তা কাগজ। যা বিশেষ ‘রিবন’ নামে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এই বিশেষ কাগজ দেশের বাইরে থেকে আমদানির যারা করেন তাদের নানান সীমাবদ্ধতায় সেটি পাওয়া যায়নি। সব শেষ পিএসসি থেকে ধার করে তিনটি কাগজ এনে ফল তৈরির কাজ করা হয়েছে। এখন আমদানি স্বাভাবিক হওয়ায় সংকট কেটেছ।
দ্রুত ফল প্রকাশ করতে নিরলস ভাবে কাজ করা হচ্ছে
লোকবল সংকট, যন্ত্রপাতি সমস্যা সহ নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘসূত্রিতা নিরসনে দিনরাত কাজ করে দ্রুত ফল তৈরি করা হচ্ছে। করোনাকালীন পরপর তিনটি পরীক্ষা একসঙ্গে নেওয়ার ফলেই অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। নিয়ম হলো একটি পরীক্ষা নেওয়ার পর ফল প্রকাশ করে অপর আরেকটি পরীক্ষা নেওয়া। কিন্তু পুনরায় করোনার সংকট বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় দ্রুত পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে কর্মকর্তা সংকট রয়েছে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নেই, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নেই। কাজ করছেন সেকশন অফিসাররা। চার লাখ শিক্ষার্থীর রেজাল্ট তৈরিতে ৪০ থেকে ৫০ জন কর্মকর্তা দিন রাত সমানভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুতই সব সংকট কাটিয়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম গতিশীল করার।
এছাড়াও আগামী ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ফাজিল স্নাতক (পাস) এর ফল এবং সেপ্টেম্বর-২০২২ ও অক্টোবর-২০২২ এর মধ্যে যথাক্রমে ফাজিল স্নাতক (সম্মান) ২০২০ এবং কামিল স্নাতকোত্তর ১ম ও ২য় বর্ষ পরীক্ষা-২০২০ এর ফল প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
আরএইচটি/এসএম