প্রেন চ্যুং ম্রো

তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন প্রেন চ্যুং ম্রো। হঠাৎ প্যারালাইজড হয়ে যান মা। বাড়িতে থেকে মাকে খাইয়ে দিতেন, সেবাযত্ন করতেন পুরোটা সময়। এভাবেই চলে টানা ৬ বছর। জানালার পাশে বসে অন্যদের ফুটবল খেলা দেখে প্রেন ভাবতেন, আহ! এরা কতই না স্বাধীন! সেই সময় থেকেই প্রেনের মাথায় ঘুরতো শুধু ফুটবল খেলা।

ফুটবল প্রেমী সেই প্রেন চ্যুং সম্প্রতি নাম লিখেছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। পা দিয়ে এক মিনিটে সর্বোচ্চ ২০৮ বার ফুটবল ট্যাপ করে গিনেস রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন তিনি। স্বীকৃতিমূলক ই-মেইলটি গত বুধবার (২ নভেম্বর) পেয়েছেন বলে ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন।

বর্তমানে প্রেন চ্যুং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত। তার জন্ম বান্দরবান সদরের ৪নং সুয়ালক ইউনিয়নের লামার পাড়ায়। দুই ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি।

প্রেন চ্যুং বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির দিকে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে। দেখলাম বাংলাদেশে সর্বোচ্চ গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী কনক কর্মকারে ভিডিও। তারপর ভাবলাম আমিও চেষ্টা করে দেখি। প্রথমে সহজ ক্যাটাগরি থেকে একটা বেছে নিয়েছি যেটার নাম ছিল ‘মোস্ট ফুটবল (সকার) টু ট্যাপস ইন ওয়ান মিনিটস’। ফুটবলার হিসেবে এই রেকর্ডটা কঠিন ছিল না। টুকটাক ফুটবল ফ্রিস্টাইল করতে পছন্দ করতাম আর ভিডিও করে নিজের পেইজে দিতাম। দুই দিন প্র‍্যাক্টিস করে ভিডিও বানিয়ে ফেললাম। তারপর গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আবেদন করলাম। এক মাস পর সাড়া দেয় তারা। এরপরআরও এক মাসে পর প্রয়োজন কাগজ পত্র সাবমিট করতে বলে।

তিনি আরও জানালেন, গত ৩ মে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ‘মোস্ট ফুটবল (সকার) টু ট্যাপস ইন ওয়ান মিনিটস’ ক্যাটাগরিতে কুমিল্লার কনক কর্মকারের রেকর্ড ভঙ্গ করার আবেদন জানিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন। আবেদনের প্রায় এক মাস পর গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়। তারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের নির্দেশনা জানায়। সেই নির্দেশনা মেনে গত ২৪ এপ্রিল তিনি ১ মিনিটে পা দিয়ে সর্বোচ্চবার (২০৮) ফুটবল ট্যাপ করার ভিডিও করে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি সংযুক্ত করে গিনেস ককর্তৃপক্ষকে পাঠান। এর মধ্যে আবার ঢাকার মুন্তাকিমুল ইসলাম কনক কর্মকারের রেকর্ড (১৯৭ বার) ভেঙে ১ মিনিটে ২০৭ বার ফুটবল ট্যাপ করে রেকর্ড করেন।

এরই মধ্যে পেরিয়ে যায় ৬ মাসেরও বেশি সময়। কর্তৃপক্ষ সব যাচাই বাছাই করে গত বুধবার (২ নভেম্বর) তারা প্রেন চ্যুং ম্রোর রেকর্ডটির (১ মিনিটে ২০৮ বার) স্বীকৃতি দেয় এবং গিনেসের ওয়েবসাইটে রেকর্ডটি অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে স্বীকৃতিপত্র হাতে পেরে আরো কিছুদিন সময় লাগতে পারে।

ফুটবলই তার ধ্যানজ্ঞান
ছোট্ট বেলায় অসুস্থ মায়ের সেবাযত্ন করতে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সুযোগ কম মিলেছে। তবে একটু সুযোগ হলেই ছুটে যেতেন প্রেন চ্যুং। খেলাধুলা করে পাওয়া টাকাপয়সা বাবার হাতেই তুলে দিতেন। তিনি বলেন, ২০২০-২১ সিজনে ঢাকায় প্রথমবারের মতন বিসিএল খেলার সুযোগ পাই। আর ২০২১ মৌসুমে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার লিগ খেলা শুরু করি। সে বছরেই ব্রাদার্স ইউনিয়ন চ্যাম্পিয়ন হয়। পাশাপাশি জেলা টিম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের টিমে খেলছি। ২০১৮ সালে কুষ্টিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় টিম ২য় রানার আপ  হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পড়ালেখাটাকে প্রয়োরিটি দিচ্ছি তাই ঢাকায় গিয়ে নিয়মিত লিগ খেলাও সম্ভব হয়ে উঠে না।অনেক কষ্টের পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। আগে পড়াশোনা শেষ করে নিতে চাই। ফুটবল তো আমার ধ্যানজ্ঞান। যা ছাড়া আমাকে চিন্তা করতে পারি না।

সব বাঁধা মাড়িয়ে
বান্দরবানের ১১টি জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে ম্রো জাতি একটি। সেই জাতির একজন প্রেন চ্যুং। জনসংখ্যা দিক দিয়ে বান্দরবানে ২য় হলেও শিক্ষা দীক্ষায় অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে। এদিকে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে অসুস্থ মা। কৃষিকাজ করে বাবার সামন্য আয়ে টানাটানির সংসার। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এলেও উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথ জানা ছিল না তার। মোবাইল কেনার জন্য মেঝ দিদির দেওয়া ৭ হাজার টাকা নিয়ে চলে আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত ভাই লেংঙি ম্রোর কাছে। লেংঙি চবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীর। 
তিনি বিনা পয়সায় টানা ৩ মাস পড়ানোর ফলে ফুটবল ইভেন্টে ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সাইন্স বিভাগে ভর্তি হবার সুযোগ পান প্রেন চ্যুং। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির একবছর পর বাবা মা দুজনই মারা যান।

প্রেন চ্যুং ম্রো বলেন, দীর্ঘ ৬ মাস অপেক্ষার পর এই রেকর্ড হোল্ডার হতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত। আমি সবসময় এমন কিছু করতে চেয়েছি যেটা আমার এবং জাতির জন্য নতুন কিছু হবে। আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এ সম্ভবত আমাদের পাহাড়িদের থেকে এখন পর্যন্ত কেউ নেই। তাই এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি। সবকিছু নিজের চেষ্টায় করেছি, ফলও পেয়েছি। আমি ভেবেছিলাম এটা হবে না তাই আরো ২-৩ টা রেকর্ড প্র‍্যাক্টিস অফ করে ফেলছিলাম। তবে রেকর্ড টা হয়ে গেল। এই রেকর্ডটা আমার অনুপ্রেরণা হবে পরবর্তী আরেকটা নতুন রেকর্ড ভাঙ্গার জন্য।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন অনেকেই। একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী চলন্ত চাকমা বলেন, বিভাগের ছোট ভাই হিসেবে তার খেলা দেখছি। সে একজন প্রতিভাবান ফুটবল খেলোয়াড়। নিজের বিভাগের ছোট ভাই হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। অনেক সংগ্রাম রয়েছে তার। যা কখনো সে বলতে চায় না। নিজের কাজটা খুব ভালো করে করার বাসনা তার মধ্যে সবসময় কাজ করে। আশা করি সামনে আরও ভালো করবে।

বিভাগের সহপাঠী ফাহমিদ হক দীপ্ত বলেন, প্রেন অনেক ভালো ফুটবল খেলে। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল দলের একজন সদস্য এবং প্রায়ই বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেয়।
তার ফেসবুকে সে বিভিন্ন ফ্রি-স্টাইল ফুটবল ভিডিও শেয়ার করে। গিনেস বুকে তার এই অনন্য অর্জনে আমরা অনেক আনন্দিত এবং পাশাপাশি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।

বান্দরবনের সুয়ালক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উক্যনু মারমা ঢাকা পোস্ট‌কে ব‌লেন, আমার সুয়ালক  ইউনিয়নের লামার পাড়ার সন্তান প্রেন চ্যুং ম্রো গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন শুনে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তার এই সাফল্যের কথা এলাকায় জানাজানি হলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আনন্দ উৎফুল্ল বিরাজ করছে। আমরা তার সাফল্য কামনা করছি।

ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমন অর্জন সত্যিই অন্যরকম গর্বের ব্যাপার আমাদের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। আমি খবরটা জানতে পারলাম এখন। তবে পরবর্তী সময়ে উপাচার্যকে বিষয়টি অবগত করে এই শিক্ষার্থীকে যতটুকু সম্ভব আমরা অভিনন্দিত করার চেষ্টা করবো।

এর আগে এক মিনিটে সবচেয়ে বেশি বার পা দিয়ে ফুটবল ট্যাপ করার রেকর্ডটি ছিল ঢাকার মুন্তাকিমুল ইসলাম নামে এক যুবকের। তিনি ১ মিনিটে ২০৭ বার ফুটবল ট্যাপ করেছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এই রেকর্ডটি করেন তিনি।