রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যবিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান

কথায় আছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সদ্যবিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান এই লোককথার মর্মার্থ এখন অক্ষরে অক্ষরে অনুধাবন করছেন হয়তো। কেননা শুধুমাত্র শিক্ষক হিসেবে আবদুস সোবহানের সুখ্যাতি ছিল লোকের মুখে মুখে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক লড়াকু সৈনিক। করেছেন কারাবরণও। রাবির ইতিহাসে একমাত্র তিনিই দুই মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে শেষে এসে তরী ডোবালেন এ ভিসি।

নিজের শিক্ষকতা জীবনের সেই সুনাম উপাচার্য হিসেবে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি। গায়ে দুর্নীতির কালিমা লেপেই বিদায় নিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল জনপ্রিয় অধ্যাপক সোবহান ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। প্রথম মেয়াদেই বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডে বারবার আলোচনায় আসেন তিনি। এমনকি জেরার মুখে পড়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও (ইউজিসি)। কিন্তু তদন্ত শেষে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ২০১৭ দ্বিতীয় মেয়াদে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান। এতেই তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

যদিও তার শিক্ষকতা জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে। এমনকি কারাবরণও করেছিলেন এই অধ্যাপক। কিন্তু কেন এই অধ্যাপকের এত পরিবর্তন কিংবা কেন জড়ালেন এসব অনিয়ম ও দুর্নীতিতে? এর উত্তর সবারই অজানা। তবে কেউ কেউ বলছেন, কেবল টাকার জন্যই অধ্যাপক আবদুস সোবহান পাল্টে গেছেন আপদমস্তক।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ৬ মে ছিল তার ভিসি হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ কর্মদিবস। সেদিনই শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে ১৪১ জনকে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে যান। এই নিয়োগে মানা হয়নি কোনো শর্তই। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞাও উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে ওইদিনই তার বিরুদ্ধে উত্তাল হয় ক্যাম্পাস। শেষে পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছেড়ে যান অধ্যাপক সোবহান।

অবশ্য গত শনিবার (৮ মে) তিনি ফেরেন ভিসির দফতরে। তবে সেদিন নিজের গরজে নয়, এসেছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির ডাকে। ১৪১ জনের নিয়োগ ‘অনৈতিক’ ও ‘বিধিবহির্ভূত’ উল্লেখ করে এই কাণ্ডে জড়িতদের শনাক্তে ৬ জুন উচ্চ পর্যায়ের এই কমিটি করে দেয় মন্ত্রণালয়।

বিদায়ী ভিসিকে দীর্ঘক্ষণ জেরা করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। পরে অধ্যাপক আবদুস সোবহান দাবি করেন, মানবিক কারণেই তিনি এই নিয়োগ দিয়েছেন। তবে এই কমিটির সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদান স্থগিত করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দফতর।

অভিযোগ উঠেছে, এই চাকরি দেওয়ার নামে বিভিন্নজনের কাছ থেকে অন্তত ৫০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন অধ্যাপক সোবহান। আর এই নিয়োগ সিন্ডিকেট পকেটে পুরেছে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা। নিয়োগের আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতার রেস্তোরাঁয় বৈঠক করে এই নিয়োগ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন ভিসি।

এক নজরে অধ্যাপক আবদুস সোবহান

১৯৫৩ সালে নাটোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আবদুস সোবহান। রাজশাহী বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৪ সালে বিএসসি অনার্স এবং ১৯৭৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিকস বিভাগ থেকে এমএসসি পাস করেন।

১৯৭৯ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় যান। ১৯৯২ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি হয়।

তিনি ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রথম মেয়াদে ভিসির দায়িত্ব নেন। ২০১৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৭ মে দ্বিতীয়বারের মতো ভিসির চেয়ারে আসেন অধ্যাপক সোবহান। গত ৬ মে তিনি অবসরে গেছেন।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাউজ টিউটর, সিনেট সদস্য, সিন্ডিকেট সদস্য পদেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন সোবহান। সক্রিয় ছিলেন শিক্ষক আন্দোলনেও। ২০০০ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন অধ্যাপক সোবহান

বরাবরই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০৪ সালে তৎকালীন ভিসি ফাইসুল ইসলাম ফারুকী ৫৪৪ জনকে নিয়োগ দেন। সেই নিয়োগেও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় সোচ্চার ছিলেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান। এছাড়াও তখনকার বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধেও সরব ছিলেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ২০০ জন কর্মচারী নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে টাকার বিনিময়ে আরও ৮০০ জনের নিয়োগের চেষ্টা হয়। এ নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। সেই আন্দোলনে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান।

২০০৭ সালে ছাত্র ও শিক্ষক আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক সোবহান। আর এই কারণেই আরও ছয় শিক্ষকের সাথে তিনিও গ্রেফতার হন। টানা ১০৪ দিন কারাগারে কাটিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরেন তিনি। ২০০৮ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় অধ্যাপক আলতাফ হোসেনকে ইউজিসির শুনানিতে হাজির হতে হয়। আর তাতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন অধ্যাপক সোবহান।

উপাচার্য হয়েই রূপ বদলান অধ্যাপক সোবহান

মূলত অনিয়ম ও দুর্নীতিবিরোধী ইমেজ তাকে প্রথম মেয়াদে উপাচার্যের চেয়ারে এনেছিল। কিন্তু সেই ইমেজ টেকেনি বেশি দিন। যোগদানের পর পুরোপুরি পাল্টে যান এই অধ্যাপক। বিভিন্ন সময় শিক্ষক ও চাকরিপ্রার্থীদের করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রকাশ্যে আসে তার এসব কর্মকাণ্ড।

উপাচার্য হিসেবে সভাপতিত্ব করা প্রথম সিন্ডিকেট সভাতেই বিজ্ঞাপিত ২১টি পদের বিপরীতে ৫১ জন শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন দেন তিনি। ২০১৩ সালে প্রথম মেয়াদ শেষ করার আগ পর্যন্ত তিনি সর্বমোট ৩৩০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেন। এর মধ্যে ৯৫ জনই নিয়োগ পান অস্থায়ী ভিত্তিতে। ওই সময় ৫৯৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীও নিয়োগ দেন।

একসময় বাজেট সংকটের জন্য অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের বিরোধী ছিলেন অধ্যাপক সোবহান। অথচ তার মেয়াদেই ইউজিসির বেতন-বাজেটের অনুমোদন ছাড়াই বিশাল নিয়োগ হয়। আর এ কারণে ওই সময় ৫০ কোটি টাকারও বেশি তহবিল ঘাটতিতে পড়ে রাবি। ঘাটতি মোকাবিলায় বাড়তি ফি-র বোঝা চাপানো হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। খোলা হয় সান্ধ্যকালীন কোর্স। এ নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন দমন করেন ভিসি।
 
আচার্যকে ধোঁকা!

উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যকে (রাষ্ট্রপতি) ধোকা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে অধ্যাপক আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসবও সামনে চলে আসে।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২১ জুন এক দিনের জন্য উপাচার্য পদটি শূন্য রেখেছিলেন অধ্যাপক সোবহান। ফলিত পদার্থবিজ্ঞান এবং ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিতেই এ কাণ্ড ঘটান তিনি। যদিও এমন ঘটনায় আচার্যের অনুমতি আবশ্যক।

২১ জুন বিভাগের শিক্ষকতা পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর উপাচার্য হিসেবে ২৪ জুন রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি পাঠান। তাতে তিনি ২৯ জুন থেকে অবসর গ্রহণের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু ওই চিঠিতে তিনি ২১ জুনের স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার বিষয়টি চেপে যান। এই অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে আচার্য ও রাষ্ট্রপতি তাকে ২৯ জুন থেকে অবসর পরবর্তী উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে অব্যাহত রাখার অনুমতি দেন।

পরে বিষয়টি জানাজানি হলে উচ্চ আদালত পর্যন্তও গড়ায়। কোন কর্তৃত্ববলে অধ্যাপক আবদুস সোবহান উপাচার্য পদে বহাল আছেন, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। তবে তা আর বেশিদূর আগায়নি।

বিধি ভাঙা ও গড়ার কারিগর অধ্যাপক সোবহান

দায়িত্ব পালনের পুরো সময়জুড়েই বিধি ভাঙা ও গড়ার খেলায় মেতেছেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান। আগের মেয়াদে নিম্ন যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর দ্বিতীয় মেয়াদে পুরো নীতিমালাই পাল্টে দেন।

শিথিল করা এই নিয়োগ নীতিমালায় ২০১৭ সালের অক্টোবরে তিনি তার জামাতা এবং মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। যারা কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার দৌড়ে টিকতে পারেননি।

শুধু জামাতা-মেয়েই নয়, পরিবর্তিত নীতিমালার কারণে অনেকেরই শিক্ষক হিসেবে চাকরির সুযোগ উন্মুক্ত হয়ে যায়। এই নীতিমালায় পরবর্তী সময়ে ৩৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা আগের নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করারও যোগ্য ছিলেন না।

উপাচার্য সোবহান তার দ্বিতীয় মেয়াদে এই ৩৪ জনসহ সবমিলিয়ে মোট ৫২ জন শিক্ষক এবং ১৯১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি নিম্নস্তরের কর্মচারীদের নিয়োগের জন্যও বয়সসীমা বাড়িয়েছেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতাও কমিয়েছিলেন। সর্বশেষ গত ৬ মে যে ১৪১ জনকে অস্থায়ী নিয়োগ দেন সেই নিয়োগেও তোয়াক্কা করা হয়নি নীতিমালার। এই গণনিয়োগ ‘অনৈতিক’ ও ‘বিধিবহির্ভূত’ উল্লেখ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আর্থিকখাতে ব্যাপক নিয়মের অভিযোগ

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য নির্ধারিত বাসভবনের পাশাপাশি অধ্যাপক সোবহান একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ১৮ মাস ধরে নানা অজুহাতে দখলে রেখেছিলেন। আর এই কারণে পাঁচ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ টাকা সরকারি রাজস্ব ক্ষতি হয়। বিষয়টি উঠে আসে ইউজিসির তদন্তে।

এতে আরও প্রমাণিত হয়, প্রাক্তন এই উপাচার্য তার অপকর্ম চালাতে নিজ আত্মীয়-স্বজন এবং তার অনুগত শিক্ষকদের ব্যবহার করতেন। ইউজিসির প্রতিবেদনে সোবহান এবং আরও সাত জনের সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।

অধ্যাপক সোবহান তার মেয়াদকালের শেষ দুই মাসে তিনটি প্রকল্প অনুমোদন করেছেন। সেগুলো হলো- ১৫ কোটি টাকার ড্রেন নির্মাণ, ১২ কোটি টাকায় শিক্ষকদের কোয়ার্টারের সম্প্রসারণ এবং ৯ কোটি টাকার অডিটোরিয়াম মেরামত। এই প্রকল্পগুলোর খরচে অতিরিক্ত মূল্য ধরা হয়েছে এবং এগুলোর দায়িত্ব তার পছন্দের ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছে, যা নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক শিক্ষক।

ইউজিসির তদন্তে রাবিতে অনিয়মের কথা উঠে আসার পর গত বছরের ১০ ডিসেম্বর সবধরনের নিয়োগ কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখতে উপাচার্য আবদুস সোবহানকে নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

২০২০ সালের অক্টোবরে নিজ নামে সোবহানিয়া আল কুরআনুল করিম হিফজখানা নির্মাণ করেন উপাচার্য। কিন্তু তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে খরচ দেখানো হয় দুই কোটি টাকা। এই খবর জানাজানি হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ভিসি।

অপকর্ম জায়েজের ঢাল ‘ছাত্রলীগ’

বরাবরই অনিয়ম ও দুর্নীতি করে পার পেতে ছাত্রলীগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে অধ্যাপক সোবহানের বিরুদ্ধে। এ বছরের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শারীরিক প্রতিবন্ধীর নিয়োগের সুপারিশ আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। ওই নিয়োগের পর ভিসি সোবহান ছাত্রলীগকে নিয়োগ বাগাতে উসকে দেন।

এ নিয়ে কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সূত্র ধরে খবর ছাপে বিভিন্ন গণমাধ্যম। তাতে উল্লেখ করা হয়, চাকরির জন্য ক্ষমতাসীনদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভিসি। চাকরি না হলে পরে আবারও তাদেরকে আন্দোলনের উসকানিও দিয়েছিলেন তিনি।

সর্বশেষ ১৪১ জনের গণনিয়োগের তালিকায় রয়েছে ৪৩ ছাত্রলীগ নেতার নাম। অভিযোগ রয়েছে, বাকি নিয়োগপ্রাপ্তদের কেউ কেউ বিএনপি-জামায়াতের লোক। পারিবারিক নাপিত, কাঠমিস্ত্রি এমনকি মালির স্ত্রীকেও নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এই নিয়োগে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।

যদিও ভিসি বরাবরই দাবি করে আসছেন, নিয়োগপ্রাপ্তরা সবাই আওয়ামী পরিবারের সন্তান। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আপত্তির মুখে ঝুলে রয়েছে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদান। এই নিয়োগ বৈধ করতে ফের ছাত্রলীগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন ভিসি আবদুস সোবহান।

পোষা ‘সাংবাদিক’

নিয়োগর অনিয়ম ও দুর্নীতি ঢাকতে ভিসির বিরুদ্ধে কয়েকজন সাংবাদিক ‘কাছে রাখা’র অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম ঢাকতে ভিসির গুণগান গণমাধ্যমে প্রচার করে আসছিলেন এসব গণমাধ্যমকর্মী। সর্বশেষ ১৪১ জনের অস্থায়ী নিয়োগের তালিকায় তিনি চার সাংবাদিক নেতা ও এক সাংবাদিকের বোনকে রেখেছেন।

ভিসির এই অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ভিসির পালিত সাংবাদিকরা নানানভাবে তাদের হয়রানি করছেন। চাকরি টেকানোর আশায় নীতিনৈতিকতা ভুলে যাচ্ছেন এসব সাংবাদিক।

অধ্যাপক আবদুস সোবহানের প্রথম মেয়াদে পরিবহন দফতরের প্রশাসক ছিলেন অধ্যাপক খলিলুর রহমান। বর্তমানে তিনি বিজ্ঞান অনুষদের ডিন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রথম মেয়াদের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান। প্রথম মেয়াদে নিয়োগ করে পার পেয়ে যাওয়ায় তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আরও বেপরোয়া হন। তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেওয়া সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলেও জানান এই অধ্যাপক।

তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অধ্যাপক সোবহান অস্বীকার করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এই নিয়োগগুলো প্রয়োজন ছিল। যারা ডিজার্ভ (যোগ্য) করে তারাই নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেই অনার্স-মাস্টার্স পাস এবং আওয়ামী পরিবারের সন্তান। দীর্ঘদিন ধরে তাদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছিল। তাই আমি মানবিক কারণে ছাত্রলীগকে চাকরি দিয়েছি।

এ ধরনের নিয়োগের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা সত্ত্বেও নিজেই এই নিয়োগ দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক সোবহান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তখনকার ঘটনার প্রেক্ষিতে কোনো তদন্ত কমিটি হয়নি, অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি। অথচ আমি ছাত্রলীগকে নিয়োগ দেওয়ার কারণে এখন তদন্ত করতে হবে। আমি আমার ব্যক্তিস্বার্থে কিছু করিনি। এটা যদি আমার ব্যক্তি স্বার্থে করতাম, তাহলে অনৈতিক কিংবা অন্যায় বলতাম।

সরকারি নিষেধাজ্ঞা পরও নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী উপাচার্যের ক্ষমতাবলে এ নিয়োগ দিয়েছি। এখন যদি সরকার থেকে এ ধরনের আদেশ আসে তাহলে তো বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশই বাতিল করা উচিত। নিয়োগে অনিয়ম হয়নি দাবি করে এই নিয়োগ যৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছেন এই অধ্যাপক।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এফআর