শিক্ষার্থী না থাকায় ফাঁকা পড়ে আছে হল

করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ হয়। একই বছরের জুলাই থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও বিভিন্ন বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলো আটকে আছে। শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে ৬ মাসের বেশি সেশনজটের মধ্যে পড়েছে। কর্তৃপক্ষ এখনো পরীক্ষাগুলো নেওয়ার বিষয়ে দোটানায় রয়েছে। ফলে জট আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকবার পরীক্ষার তারিখ দিয়েও তা পরিবর্তন করে। পরীক্ষা সশরীরে নাকি অনলাইনে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়েও সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। যার কারণে এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বারবার তারিখ ঘোষণা করে শুধুমাত্র দায় সারছেন এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখছেন।

আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ঘোষণা করেছিল তারা ১৩ মার্চ থেকে হলগুলো খুলে দেবে এবং ২৭ মার্চ থেকে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

ওই সভায় বলা হয়েছিল ১৭ এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়া হবে। এরপর ১৭ মে খোলা হবে আবাসিক হল। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন এবং ১ মার্চের মধ্যে হল খোলার সিদ্ধান্ত নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। যদিও পরবর্তীতে জাতীয় সিদ্ধান্ত মেনে কর্মসূচি স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা।

এরপর ২৯ এপ্রিল প্রভোস্ট কমিটির এক জরুরি বৈঠকে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে না পারায় আবারও সিদ্ধান্ত (১৭ মে হল খোলা) থেকে সরে আসে কর্তৃপক্ষ এবং নির্দিষ্ট করে আর কোনো তারিখও ঘোষণা করেনি কর্তৃপক্ষ।

গত ৬ মে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফাইনাল/বার্ষিক পরীক্ষাসহ সকল পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে অনলাইন পরীক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করে হল-ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে গত ২৫ মে থেকে আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ, উপাচার্যকে স্মারকলিপি এবং ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশ করেন আন্দোলনকারীরা। 

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ গত ১ জুন একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় হল না খোলার শর্তে সশরীরে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ১৫ জুন থেকে স্থগিত পরীক্ষা এবং ১ জুলাই থেকে সকল বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়। তবে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে ১ জুলাই থেকে আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনলাইনে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানায় কর্তৃপক্ষ।

তবে হল না খুলে সশরীরে পরীক্ষার সিদ্ধান্তকেও প্রত্যাখ্যান করে গত বৃহস্পতিবার (৩ জুন) দুপুরে ‘হল-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দাও’ আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে সংবাদ সম্মেলন করেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, হল না খুললে শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়বে। মেসে থেকে পরীক্ষা দেওয়ার সামর্থ সব শিক্ষার্থীর নেই। তাদের দাবি, পরীক্ষার্থীদের জন্য হল খুলতে হবে অথবা ‘টেক হোম’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে হবে এবং কোনোভাবেই পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বারবার তারিখ পরিবর্তন করে দায় সারছেন এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।

ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ বলেন, আমরা হল না খোলার শর্তে সশরীরে পরীক্ষার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করছি এবং আমাদের দাবি, ধাপে ধাপে পরীক্ষার্থীদের জন্য হল খুলে দিতে হবে। পাশাপাশি ভ্যাক্সিনেশন প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে‍। ‘ইম্যিউনিটি গ্রোথ স্টেজ’ পার হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের হলে উঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করতে হবে। পূর্বে স্থগিত যেসব পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ১৫ জুন থেকেই নিতে হবে‍।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর গত বছরের ১৭  মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। কয়েক দফায় এই বন্ধের মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। সর্বশেষ ঘোষণায় ১২ জুন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটি বাড়ানো হয়েছে। এরইমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। 

টেক হোম পদ্ধতির যৌক্তিকতা তুলে ধরে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের মূল দাবি, পরীক্ষার্থীদের জন্য হল খুলতে হবে। যদি কোনোভাবে প্রশাসন হল খুলতে অপারগতা প্রকাশ করে সেক্ষেত্রে টেক হোম পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে হবে। টেক-হোম পদ্ধতির মাধ্যমে ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা করোনকালীন অনিশ্চিত পরীক্ষার জটিলতা থেকে মুক্তি পাবে। এই পদ্ধতিতে হলে পরীক্ষার অনুরূপ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর লিখে ছবি তুলে গুগল ক্লাসরুমে আপলোড দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় এতে প্রযুক্তিগত জটিলতা যেমন নেই, তেমনিভাবে এই পদ্ধতিতে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়িয়ে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে সফলভাবে মিড-টার্ম/ ইনকোর্স পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়েছে।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটাও শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এখন পর্যন্ত রোডম্যাপও প্রণয়ন করতে পারেনি। প্রত্যেক বর্ষের পৃথক পৃথক পরীক্ষা নিয়ে শুধুমাত্র পরীক্ষার্থীদের জন্য হল খুললে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব। হলে এক রুমে, দু'য়েকজনের বেশি শিক্ষার্থী থাকার প্রয়োজনীয়তাও থাকবে না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা মেসে উঠলে এক মেসে ৫-১০ জন শিক্ষার্থী একসাথে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কোনোভাবেই হলের চেয়ে মেস নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না! কার ইশারায় নিচ্ছে না সেটি বড় প্রশ্ন!

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আপাতত কোনোভাবেই হল খোলার সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে, টিকা না দিয়ে শিক্ষার্থীদের হলে তোলা যাবে না। আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি, সরকারও আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আশা করি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই টিকা পাবে। তারপরই আমরা হল খোলার দিকে অগ্রসর হতে পারব। 

পরীক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা 

শিক্ষার্থীদের দাবি হল খুলে পরীক্ষা এবং টেক হোম পদ্ধতির বিষয়ে উপাচার্য বলেন, এ বিষয়ে আলাদা করে আমার মন্তব্য করার সুযোগ নেই। আমাদের বিশাল একাডেমিক বডি আছে, তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই কার্যকর হবে।

তবে শিক্ষার্থীদের পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৪৫ শতাংশের মতো। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাইরে। যেখানে অনলাইন ক্লাসে এত পরিমাণ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত তাদের রেখে, অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া অযৌক্তিক। আমরা প্রথমে যখন অনলাইন ক্লাসের কথা বলেছিলাম, তখন বলেছি শুধুমাত্র ক্লাস অনলাইনে হবে। পরীক্ষা সশরীরে হবে।

শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকা দিয়ে হলে ওঠানোর উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক সামাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেও শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসার কথা বলেছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে এক লাখ টিকার কিছু বেশি লাগতে পারে। এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এই টিকা দ্রুত নিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা আরও এক মাস অপেক্ষা করবে। তারপরও টিকা দিয়ে হল খুলে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে হবে। অন্যথায় এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঢাকায় এসে বিপদে পড়ে যাবে।

এইচআর/এনএফ/জেএস