জীবন সংগ্রামের ৮৫ বছর পেরিয়ে ৮৬-তে পদার্পণ করলেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ এফ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের নিরলস অবদানে সমৃদ্ধ তিনি তাদের অন্যতম। আশির দশকে ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে লেখা তাঁর কলাম ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

বরেন্য এ শিক্ষাবিদ ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন জন্ম গ্রহণ করেন। আজ বুধবার তাঁর জন্মদিন। এ উপলক্ষে ঢাকা পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, জীবনের কোনো কিছু নিয়ে ক্ষোভ নেই, যা করেছি বা যা পেয়েছি। এখন নিজেকে নিয়ে আর তেমন ভাবি না। জীবনের চাওয়া পাওয়া নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমাকে ভাবতে বাধ্য করে সমাজ ও রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে যে পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল, সেই পরিবর্তন আসেনি। দীর্ঘদিন ধরে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছি, অনেক আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেটা কাঙ্ক্ষিত ছিল, রাষ্ট্র সেই দিকে যায়নি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সাধারণ মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। সর্বত্র দুর্নীতি ও অনিয়ম দেখা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। আমাদের দেশেও কিছু মানুষ অতিধনী হচ্ছে, কিছু মানুষ অতিদরিদ্র হচ্ছে। আজীবন সাম্যবাদী দর্শন চর্চা করেছি। আজীবন বিরাজমান নিপীড়ক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছি। মানুষের মুক্তির জন্য, সমাজ ব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই লড়েছি। এখনও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, মানুষের মুক্তি মেলেনি। আমাদের ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্র যেভাবে আমলাতান্ত্রিক ছিল এবং অর্থনৈতিকভাবে পুঁজিবাদমুখী ছিল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও সেই ধারাই চলমান রয়েছে। এটা দুঃখের কারণ, রাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই রয়ে গেল এবং তার অর্থনীতিও পুঁজিবাদী ধারায় চলছে।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস পৃথিবীতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে, আরও আনবে। এই করোনাভাইরাস প্রকৃতি থেকে উদ্ভব হয়েছে মানুষের কারণে। মানুষ প্রকৃতিকে উত্যক্ত করেছে, প্রকৃতি তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, খরা— সবকিছুই ঘটছে প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচারের ফল হিসেবে। করোনাও ওইরকমই কোনো প্রতিক্রিয়া, ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া। সভ্যতার পুঁজিবাদী কারিগররা মানুষ মারার অস্ত্র উদ্ভাবনে যে পরিমাণ মনোযোগ দিয়েছে, সে মনোযোগের সিকিভাগও যদি রোগপ্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য দিত, তাহলে এই মহাদুর্যোগ ঘটত না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনার কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো সেটা অপূরণীয়। শিক্ষার্থীদের মনোজগতে, মানসিক স্বাস্থ্যে একটা বড় রকমের আঘাত এসেছে। সেটা কতটা দৃশ্যমান হবে জানি না। তবে রাষ্ট্রের উচিত বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া। শিক্ষাকে যে ধরনের গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, সেটা দেওয়া হয়নি। বাজেটে শিল্প কারখানাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এ রকম শিক্ষাকেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, লেখাপড়া শিখতে হয় একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এজন্য ক্লাস রুম প্রয়োজন হয়, শিক্ষকের দরকার হয় এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগ দরকার হয়। তবে করোনা সংক্রমণ বজায় থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খোলাও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে, যেহেতু আবাসিক হলগুলোও খুলতে হবে। তবে অনলাইন ক্লাসকে কোনোভাবে আদর্শ ব্যবস্থা বলা যাবে না। অনেক শিক্ষার্থী এতে বঞ্চিত হতে পারে, এটি যথাযথ ব্যবস্থা নয়। এর বিকল্প কী, সেটা ভাবতে হবে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ১৯৩৬ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস এবং লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৭ সালে। তিনি ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। দুবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের উপাচার্য নিয়োগের প্যানেলে মনোনয়ন পেলেও ভিসি পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহিত্যকর্মে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বাংলা একাডেমি স্বর্ণপদক’, ‘বিচারপতি ইব্রাহিম পুরস্কার’, ‘অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার’, ‘বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবুল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার’সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।

এইচআর/এসকেডি/জেএস