বাঁয়ে সাঈদা নাসরিন ও ডানে তপন কুমার পালিত

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদা নাসরিনের মৃত্যুতে সহকর্মীদের মাঝে নেমেছে শোকের ছায়া।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তপন কুমার পালিত নিজের সহকর্মী সাঈদা নাসরিনকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্মৃতিচারণা করেছেন। তারা একসময় সহপাঠীও ছিলেন। 

তপন কুমার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, সাঈদা নাসরিন বাবলী ২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সঙ্গে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়। পরের বছর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে আবারও ইতিহাস বিভাগে ফিরে আসে। সে হিসেবে বাবলী আমার সহপাঠী ও বন্ধু। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে আমরা দুজন একইসঙ্গে ২০১৩ সালে যোগদান করি। মনের দিক থেকে সত্যিকারের অসাধারণ একজন মানুষ ছিল বাবলী। সবসবময় হাসিখুশি থাকত। ছাত্রছাত্রী এবং সহকর্মীদের মধ্যে নিজগুণে ছিল জনপ্রিয়।

গত মাসের ২৪ তারিখ ছিল ওর পিএইচডি সেমিনার। এ নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। এর মধ্যে ২০ জুন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়- ‘আমি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছি’। এ স্ট্যাটাস দেখে আমি মনে করেছিলাম হয়তো পিএইচডি নিয়ে চিন্তায় এমন লিখেছে। তাই কমেন্টে লিখেছিলাম, তোমার তো এখন মরার সময় থাকার কথা না, সেমিনারের প্রস্তুতি নাও। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ও লিখেছে ‘প্রচণ্ড জ্বর’। এরপর ওর ফোনে কল করে আর পাইনি।

পরবর্তী ঘটনা আপনারা সকলেই জানেন। ও আসলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আমাদের ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা ওর জন্য প্রতিনিয়ত দোয়া করেছেন। সবার দোয়ায় কিছুটা সুস্থও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে আবার ব্রেনস্ট্রোক করে অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে যায়। 

তারপরও আমরা আশায় ছিলাম সবার দোয়া ও ওর নিষ্পাপ ছেলেটার জন্য হয়তো আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। কিন্তু গতকাল ৬ জুলাই দুপুরে ডাক্তার দ্বীন মোহাম্মদ এসে দেখে বলেছিলেন যে, ওর ব্রেন আসলে ডেড। এ অবস্থা থেকে ফিরে আসার কোনো রেকর্ড নেই। এখন পরিবার ইচ্ছে করলে এভাবে কোমায় রাখতে পারে। কিন্তু সেটা আসলে ওকে কষ্টই দেওয়া হবে। তাই পরিবারকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়।

কাল দুপুর একটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক বাশার (সাঈদা নাসরিনের স্বামী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার) ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম। তাই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা কষ্টকর, তা বুঝতে পেরেছি। ভেতরে ঢুকে যখন দেখলাম ওর বুক ওঠানামা করছে, মানে ওর প্রাণ আছে। তখন আসলে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু আসলে এ শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল কৃত্রিম। তাই পরিবারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ওকে দেখার পর বুঝা গেছে আসলে নিষ্প্রাণ দেহ, কিন্তু শ্বাস চলছে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত রাত আটটার দিকে সিদ্ধান্ত হয় যে, আর কোনো আশা নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওর স্বামীর বন্ডসই ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে সম্মত ছিল না। আর বাশার ভাইয়ের পক্ষে এ সিদ্ধান্ত দেওয়া ছিল খুবই কষ্টকর। ডাক্তার বলেছিলেন, মেডিসিন কমিয়ে দিলে ১-২ ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সিদ্ধান্তে রাত ১১টার দিকে বলা হয় যে, আস্তে আস্তে মেডিসিনের পরিমাণ কমিয়ে দিলে এমনিতেই শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর সকালে বাড়িতে নেওয়া হবে। 

সে সময়ে হাসপাতালে পরিবারের সঙ্গে ইতিহাস বিভাগের মোহাম্মদ সেলিম স্যার, মামুন ভাই, বেলাল ভাই, নাসির ভাই, হাসান ভাই, মুর্শিদা আপু, শাহিদ, সামাদ, খালেদা, হৃদয়, বাংলা বিভাগের আদিত্য, ভূগোলের কাদের ভাই, সাংবাদিকতা বিভাগের জাকারিয়াও ছিলেন। এ সিদ্ধান্তের পর আমরা বাশার ভাইসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিচে চলে আসি। এরপর বাসায় আসার পর ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা ফোন করছিলেন। এ নির্মম সত্য আপনাদের বলার মতো শক্তি আমার ছিল না। তাই বিস্তারিত না বলে শুধু বিদায় জানিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে ভোর ৪টায় বাবলী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়ে বন্ডসই করা হয়ে গিয়েছিল, তাই আর কিছু করার ছিল না। ডাক্তাররা কোনো আশার বাণী শোনাননি। যদি উনারা বলতেন, এক ভাগ সম্ভাবনাও আছে, তাহলেও পরিবার শেষ চেষ্টা করত। যেহেতু কোনো কিছুই করার ছিল না, তাই শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

আমাদের প্রিয় সহকর্মী বাবলীর আত্মার শান্তি কামনা করছি। বাবলীর এ চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সকলে সাবধানে থাকবেন, ভালো থাকবেন।

সাঈদা নাসরিন বাবলী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২০ জুন স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। ২১ জুন তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় বুধবার ভোরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুকালে এক শিশুপুত্র, স্বামীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ও রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বাবলী ৩২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হন।

এমটি/আরএইচ