সামিয়া রহমানের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

গবেষণাপত্রে ‘চৌর্যবৃত্তি’ করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাবি সিন্ডিকেট। এমন ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে অবনমন করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট এই সিদ্ধান্ত নেয়। ইতোমধ্যে এই শাস্তির বিরুদ্ধে রিট করার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাবির এ শিক্ষক। ঢাকা পোস্ট-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে নানান কথা উল্লেখ করেন।

আমি সম্পূর্ণ নোংরা রাজনীতির শিকার। এই ঘটনাকে কেন্দ্র যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল, সেখানে আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো প্রমাণ পায়নি তারা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার কোনো সম্পৃক্ততা তারা খুঁজে পায়নি। কিন্তু সিন্ডিকেট ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত মানেনি।

সামিয়া রহমান,সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শাস্তি হিসেবে সহযোগী থেকে সহকারী হওয়া এ শিক্ষক বলেন, ‘আমি এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ, তারচেয়ে বেশি খারাপ মানসিক অবস্থা। আমি বাঁচি আর না বাঁচি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করব। আমি যদি নাও বাঁচি আমার বাবা, স্বামী-সন্তানদের বলে যাব তারা যেন মামলাটি করে যায়, যাতে তাদের এই নোংরামি প্রমাণিত হয়।’ এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সামিয়া রহমান।

গবেষণায় ‘চৌর্যবৃত্তির’ প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে সামিয়া রহমান বলেন, ‘মূলত লেখাটা আমি জমা দেইনি। আমি জানতামও না যে মারজান (মাহফুজুল হক মারজান, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে প্রভাষক) লেখাটা (যৌথ গবেষণা) জমা দিয়েছে। আমি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন উপাচার্য আরেফিন (আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী) স্যারকে লেখা প্রত্যাহারের জন্য চিঠিও দিই, যাতে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের তৎকালীন ডিন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ স্যারের স্বাক্ষরও রয়েছে। আরেফিন স্যার আমাকে বলেছিলেন, ডিনকে বল সিন্ডিকেটে বিষয়টা তুলতে, আমি এর সমাধান করে দিতে চাই। এটাতে প্ল্যাজারিজম নেই, যদি থাকত তাহলে ফুকো (মিশেল ফুকো, ফরাসি দার্শনিক) বলেছিল বা রেফারেন্স না থেকে সরাসরি তোমাদের ভাষায় লেখা থাকত।’

তিনি বলেন, ‘আমি ফরিদ স্যারকে বারবার বিষয়টা তুলতে অনুরোধ করি, কিন্তু তিনি তোলেননি। উল্টা তিনি আমাকে বলেন, তুমি আরেফিন স্যারের অনুসারী তিনি তোমাকে শাস্তি দেবে না। এরপরও বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তোলেননি। সাত মাস পর যখন আরেফিন স্যারের দায়িত্ব শেষ হয়, তখন তিনি আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, এখন আমি প্রতিশোধ নেব। মারজানের কারণে আমাকে আরেফিন স্যার ডিনের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে তদন্তে যখন ডাকা হয়, তখন আমাকে কোনো কথা বলতে দেওয়া হয়নি। শুধু বলেছিলাম, আমার নামে কেউ লেখা দিল অথচ আমি জানতেও পারলাম না। এটা বলার পর সাদেকা হালিম এবং তৎকালীন উপ-উপাচার্য নাসরিন ম্যাম আমাকে বারবার বলছিলেন, আমি দায়ী, সব দোষ আমার। তাদের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার আমি।’

তারপর এই বিষয়টি দীর্ঘ চার বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়। আমি ২০১৯-এ বর্তমান উপাচার্য আখতারুজ্জামান বরাবর একটা চিঠি দিই, যাতে তদন্ত কমিটির সদস্য পরিবর্তন করে। কেননা সাদেকা হালিমসহ আরও কয়েকজন বিভিন্ন পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন এবং আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলা হয়েছিল। যদি আমি চাকরি ছেড়ে দিই তাহলে আমি এটা থেকে অব্যাহতি পাব। কিন্তু আমি চাকরি ছেড়ে দেইনি এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছিলাম কেননা আমি নিরপরাধ।

সামিয়া রহমান, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘পরবর্তীতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তদন্তের জন্য অধ্যাপক রহমাতুল্লাহ এবং অধ্যাপক জিন্নাত হুদাকে আহ্বায়ক করে একটা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। যাতে বলা হয়, সামিয়া এই লেখা জমা দিয়েছিল তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাছাড়া মারজান নিজেই স্বীকার করেছিল সে নিজেই লেখাটা জমা দিয়েছে। তাছাড়া এডিটোরিয়াল (সম্পাদকীয়) বোর্ড এবং রিভিউয়ার (পর্যবেক্ষক) তাদের দায়িত্ব পালন করেননি।’

সামিয়া রহমান বলেন, ‘এসব কিছুর পরও শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট আমার বিরুদ্ধে এই রায় দেয়। যাতে খুবই হতাশ। আমি আদালতে যাব, এর বিরুদ্ধে রিট করব এবং সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করব। যারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত সবার মুখোশ উন্মোচন করব। যদি আমি মরেও যাই আমার স্বামী-সন্তানদের বলব, বিরুদ্ধে এই মহিলা (হালিমা সাদেক) এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে যেন ছেড়ে না দেয়। তাদের নোংরামির যেন প্রমাণ পাওয়া যায়।’

এর আগে, সামিয়া রহমানের পিতা কাজী মাহমুদুর রহমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার মেয়ের শারীরিক এবং মানসিক অবনতি হয়েছে উল্লেখ করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। তাছাড়াও সামিয়া রহমানের যদি কিছু হয়ে যায় এর জন্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম এবং উপাচার্য আখতারুজ্জামান দায়ী থাকবেন বলে উল্লেখ করেছিলেন।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সামিয়া রহমান ও মাহফুজুল হক মারজানের যৌথভাবে লেখা ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার : এ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ শিরোনামের আট পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’ জার্নালে প্রকাশিত হয়।

এটি ১৯৮২ সালের শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’তে প্রকাশিত মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি নিবন্ধ থেকে প্রায় পাঁচ পৃষ্ঠা হুবহু নকল বলে অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এক লিখিত অভিযোগে মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এই চুরির কথা জানিয়েছিল ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস।

অভিযোগটি তদন্তে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমদকে প্রধান করে একটি কমিটি করে সিন্ডিকেট। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সামিয়া-মারজানের চৌর্যবৃত্তির অভিযোগটির সত্যতা মিলেছে। তবে কমিটি কোনো শাস্তির সুপারিশ করেনি। সামিয়া-মারজানের শাস্তি নির্ধারণের জন্য গত বছরের অক্টোবরের সিন্ডিকেট সভায় আইন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল ইনক্রিমেন্ট কাটার মতো ‘লঘু শাস্তির’ সুপারিশ করলেও সিন্ডিকেট তা নাকচ করে দিয়েছে।

সামিয়া-মারজানের গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি নিয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটির সদস্য ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি জানিয়েছিলেন, অভিযোগ ওঠা নিবন্ধটিসহ সামিয়া-মারজানের যৌথভাবে লেখা মোট ছয়টি নিবন্ধ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিটি নিবন্ধে ৬০-৮০ শতাংশ করে চৌর্যবৃত্তি করা হয়েছে।

এদিকে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে ২০১৮ সালে সিন্ডিকেটের এক সভা থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুকের ডিগ্রি বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু তখন তাঁকে একাডেমিক কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। তাঁর শাস্তি নির্ধারণের জন্য গত বছরের অক্টোবরের সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী ও সিন্ডিকেট সদস্য এ এফ এম মেজবাহ উদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে পদাবনতি দিয়ে প্রভাষক করে দেওয়ার সুপারিশ করে৷ সেই সুপারিশই সিন্ডিকেট বহাল রেখেছে।

আমজাদ/এফআর