বিভাগীয় শহর রংপুরে শহীদদের নামে কিছু সরণি থাকলেও নেই প্রচার-প্রচারণা। সড়কের এক কোণে দৃষ্টির আড়ালে পড়ে থাকা এসব শহীদ সরণি নামফলকে সীমাবদ্ধ। সরকারি-বেসরকারিভাবে ব্যাপক প্রচারণা না থাকায় নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা শহীদদের পরিচয়-পরিচিতি। সড়কের নাম ফলকে থাকলেও কাগজে-কলমে প্রচারণায় নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। ফলে কালের বিবর্তনে সাহসী শহীদ সন্তানদের নাম ইতিহাস থেকে মুছে যেতে বসছে।

সচেতন মহলসহ শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ভাষা সৈনিকসহ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হোক। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে সরণির ফলকের সঙ্গে যুক্ত করা হোক সংগ্রামীদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস।

প্রয়োজনে জীবিত ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরঙ্গনাদের নামেও হতে পারে নতুন নতুন সরণি। আর এর জন্য সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনসহ সব রাজনৈতিক মহলকে উদ্যোগ গ্রহণে অনুরোধ জানিয়েছেন শহীদ পরিবারগুলো।

আশির দশকে রংপুর পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ আফজাল শহীদদের নামে অনেকগুলো সড়কের নামকরণ ও ফলক স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি ও প্রচারণার অভাবে নামকরণের সেই ফলক ও সাইনবোর্ডগুলোর বেশির ভাগই নেই। এখনো নগরীর বিভিন্ন সড়কে হাতেগোনা কয়েকটি সাইনবোর্ড ও ফলক রয়েছে। 

বর্তমান সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান সম্প্রতি কয়েকটি সড়কের সংস্কার শেষে নতুন করে শহীদের নামে করা সরণির ফলক স্থাপন করেছেন। কিন্তু এসব সড়ক ঘিরে প্রচারণা না থাকায় বেশির ভাগ মানুষই জানে না শহীদ সরণির নাম। আবার কিছু কিছু সড়কের নাম ফলকে ভুল বানান ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে।  

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ২০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন সংগ্রামে প্রথম শহীদ হন রংপুরে। সেই শহীদ শিশু শংকু সমজদারের নামে নগরীর শাপলা চত্বর থেকে তাজহাট পর্যন্ত সড়কের নামকরণ হওয়া উচিত। এই সড়কেই শংকুর রক্ত ঝড়েছে। এক সময় রংপুর শহরের অনেক সড়কের নাম শহীদদের নামকরণে হয়েছিল। কিন্তু  সচেতনতার অভাবে আজ সেইসব নাম হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে বর্তমান সিটি পরিষদ শহীদদের নামে সড়কের নাম ফলক স্থাপন শুরু করেছে।

দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস চর্চা, গবেষণা ও লেখালেখির কাজ করছেন রিয়াদ আনোয়ার শুভ। আশির দশকের স্মৃতি তুলে ধরে এই লেখক বলেন, নিজ চোখে শাপলা চত্বরের (তৎকালীন তেঁতুলতলা) তিন কোনা পার্কটির শহরমুখী কোনায় শহীদ শংকু সরণির নামফলক দেখেছি। রংপুর পৌরসভার আশির দশকের দলিল অনুসারে শহরের বিভিন্ন সড়কের নাম অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের নামে হয়েছিল।

তিনি জানান, রংপুর শহরের মূল সড়কের ডিসি বাংলো থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত অংশের নাম দুই ভাগে শহীদ জররেজ সরণি (ডিসি বাংলো থেকে রামমোহন ক্লাব) ও শহীদ মুখতার ইলাহির (রামমোহন ক্লাব থেকে শাপলা) নামে ছিল। এছাড়াও নগরীর বেতপট্টি সড়কটির (চৌরাস্তার ট্রাফিক আইল্যান্ড পর্যন্ত) নামকরণ করা হয়েছিল শহীদ ওমর আলী সরণি, সেন্ট্রাল  রোড শহীদ মোবারক সরণি, গোমস্তা পাড়া থেকে পাল পাড়ার দিকে যে রাস্তা চলে গেছে তার নাম শহীদ রনি রহমান সরণি। নগরীর দেওয়ান বাড়ি থেকে যে রাস্তাটি থানার পেছন দিয়ে মুলাটোলের দিকে চলে গেছে, সেই সড়কের নাম শহীদ অশ্বিনী কুমার ঘোষ সরণি। শহীদ ভিকু চৌধুরীর নামানুসারে হয় বেতপট্টি থেকে সেনপাড়ামুখী সড়কটির নাম।

এছাড়া স্টেশন রোড থেকে দরদী সিনেমা হলের বিপরীত দিয়ে আজিজনগর কলোনির ভেতরের মূল সড়কটির নামকরণ করা হয় শহীদ চিকিৎসকের নামানুসারে শহীদ ডা. মর্তুজা সরণি। মুরগির খামার মোড় থেকে পীরপুর অভিমুখী সড়কের নামকরণ হয়েছিল শহীদ ইসমাইল হোসেন বসু মিয়া সরণি। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার নেতৃত্বদানকারী সংগ্রামী শাহেদ আলীর নামে পীরজাবাদের সড়কের নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বেশির সড়কে এসব সরণির কোনো স্মৃতিচিহ্ন বা ফলক নেই। কাগজে-কলমে, সাইনবোর্ডে বা বাসার ঠিকানা ব্যবহারেও এসব সরণির কোথাও তেমন প্রচারণা নেই। যার কারণে বর্তমান প্রজন্ম শহীদ সরণি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে অভিযোগ করেন সচেতন এই লেখক।  

রংপুরের সাবেক পৌর চেয়ারম্যান ও শহীদ পরিবারের সদস্য কাজী মো. জুননুন বলেন, রংপুর শহরের অনেক সড়ক বিভিন্ন সময়ে নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের দায়িত্বহীনতার কারণে সেই সরণিগুলো এখন নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা। ভাষা আন্দোলন ও  মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশে সড়কের নামকরণে শহীদদের নামফলক অনেক গুরুত্ব বহন করে। অথচ এ ব্যাপারে কারও কোনো উদ্যোগ নেই।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর জেলা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন বলেন, বর্তমান সিটি মেয়র ও তার পরিষদ চাইলে আশির দশকের দলিল বের করে সড়কগুলোর নাম নিশ্চিত হয়ে পুনরায় সড়কের নামফলক স্থাপন করতে পারেন। এতে অন্তত আগামী প্রজন্ম আমাদের ভাষা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর শহীদদের নাম ও তাদের পরিচয় জানতে পারবে। 

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র মাহমুদুর রহমান টিটু বলেন, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে শহীদদের নামে নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। আমাদের এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এবার শুধু নামকরণ নয়, যাতে নামের ব্যবহার হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে নামফলকের সঙ্গে শহীদদের পরিচয় পরিচিতি তুলে ধরার ব্যাপারে সিটি পরিষদ আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবেন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি