না খেয়ে থেকেছি, তবুও সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ হতে দিইনি
প্রায় দেড় যুগ আগে দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হই। মাথা গোঁজার ঠাইঁ না থাকায় ছোট ছোট দুটি ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে থাকি যাযাবরের মতো। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর ঘর বাঁধতে ইচ্ছে করেনি। অবশেষে ঠাঁই হয় বাগেরহাট সদর উপজেলার সুগন্ধি আশ্রয়ণে। সন্তানদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে এলজিইডির পল্লী সড়কের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচিতে দৈনিক মজুরিতে কাজ শুরু করি।
দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে রাস্তার কাজ করেই সংসার চালাচ্ছি। আমার স্বল্প আয়েই সন্তানদের লেখাপড়াসহ যাবতীয় খরচ চালিয়েছি। সন্তানদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে প্রয়োজনে না খেয়ে থেকেছি, কিন্তু পড়াশুনা বন্ধ হতে দেইনি। ছেলেদের জন্য আমি সব করতে পারি।
বিজ্ঞাপন
কথাগুলো বলছিলেন বাগেরহাট সদর উপজেলার রাখালগাছীর সুগন্ধি আশ্রয়ণের বাসিন্দা রেকসোনা বেগম (৫০)। সন্তানদের পড়ালেখা করাতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। তবে তার কষ্ট স্বার্থক হয়েছে। রেকসোনার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সম্প্রতি তার ছোট ছেলে শরিফুল বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি পেয়েছেন, আর বড় ছেলে রবিউল ইসলাম চাকরি করছেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। রেকসোনার এই আনন্দ যেন ছুঁয়ে গেছে আশ্রয়ণের প্রতিটি মানুষকে।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, ২৫ বছর আগে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ফয়লা এলাকার দরিদ্র রকিব উদ্দিন শেখ ও মরিয়ম বেগম দম্পত্তির ছোট মেয়ে রেকসোনার সঙ্গে বিয়ে হয় সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের সদুল্যাপুর এলাকার সাত্তার শেখের। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে রোকসানা সবার ছোট বলে একটু বেশিই আদরের ছিলেন। তাই তো সাধ্যের সবটুকু দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেন বাবা রকিব উদ্দিন। একমাত্র চাওয়া মেয়ে যেন ভালো থাকে। কিন্তু সুখ বেশি দিন সয়নি রেকসোনার। বিয়ের কদিন পর থেকেই নির্যাতন শুরু করে স্বামী। শত নির্যাতনেও ছেলেদের কথা ভেবে সংসার করতে থাকেন তিনি।
কিন্তু ১৭ বছর আগে এক রাতে দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে নিয়ে আসেন স্বামী। তালাক দেন তাকে। বাধ্য হয়ে রোকসানাকে ছাড়তে হয় স্বামীর ঘর। ততদিনে বাবা মারা গেছেন, ভাইদের বাড়িতেও যেতে পারেননি। বড় ছেলে রবিউল তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে শরিফুল প্রথম শ্রেণির ছাত্র। সেই থেকে কখনো মানুষের বাড়ি, কখনো আবার খাবারের হোটেলে কাজ করেছেন। তবে এক যুগের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পল্লী সড়কের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচিতে দৈনিক মজুরিতে কাজ করে আসছেন তিনি। রচনা করেছেন হার না মানা এক সংগ্রামী নারীর গল্প।
রেকসোনার ছোট ছেলে শরিফুল ইসলাম বলেন, ছোট বেলা থেকে বাবাকে কাছে পাইনি। মা অনেক কষ্ট করে আমাদের দুই ভাইকে বড় করেছেন। রাস্তায় কাজ করার টাকা দিয়ে বই কিনে দিয়েছেন। মা-ই আমাদের সব। মাকে ঘিরেই আমাদের পৃথিবী। আজকে আমি যে চাকরি পেয়েছি তাও মায়ের অবদান। আবেদন ফির ৫০ টাকাও মা দিয়েছিলেন আমাকে। আল্লাহ আমার মাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখুক সেই দোয়া করি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা হাছিম হাওলাদার বলেন, প্রায় ১৩ বছর আগে দুই ছেলেকে নিয়ে সুগন্ধী আশ্রয়ণে আশ্রয় নেন রেকসোনা। সেই থেকে কঠোর পরিশ্রম, বাবার শাষণ আর মায়ের স্নেহ-ভালোবাসায় দুই ছেলেকে বড় করে তুলেছেন তিনি। তার স্বভাব-চরিত্রও খুব ভালো। আজ রেকসোনার আনন্দে আশ্রয়ণের আমরা সবাই অনেক আনন্দিত।
রাখালগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু শামীম আসনু বলেন, রেকসোনা দীর্ঘদিন ধরে এলজিইডির পল্লী সড়কের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচিতে মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন। তিনি চাইলে ছোট ছোট দুটি ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে কাজ করে উপার্জন করেছেন। ছেলেদের মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তিনি আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত।
বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, রেকসোনা বেগম একজন সফল নারী। তবে এই সফলতার পেছনে কঠিন সংগ্রামের গল্প আছে। ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ফের ঘর বাঁধেননি। ছেলেদের বড় করতে তিনি যে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন, লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার।
আরআই