‘গত বছর আমার পুতের বউ মরল, নাতনি মরল, বেয়াইন মরল। এ বছর দেবরের পুতের বউ মরল, নাতি মরল, মুন্সীগঞ্জের মানুষ কি  বার বার মরব? কারও কিছু করার নাই? এটার কি আচার-বিচার নাই? সরকার কি কিছু করতো না?’

সোমবার (২১ মার্চ) দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন দুই বছরে লঞ্চ দুর্ঘটনায় পাঁচ স্বজনকে হারানো মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রমজানবেগ গ্রামের মিনু বেগম (৬৫)। তিনি ওই গ্রামের কাজি মিয়ার স্ত্রী। 

গত বছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় পুত্রবধূ বীথি বেগম (২৫), নাতনি আরিফা (১) ও বেয়াইন পাকিজা বেগম (৪০) মারা যান। গতকাল রোববার (২০ মার্চ) লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তার প্রতিবেশী দেবরের পুত্রবধূ আরিফা বেগম (৩৫) ও নাতি সাফায়েত (১৫ মাস)।  

এদিকে রোববার (২০ মার্চ) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে নিহত আরিফা ও শাফায়াতকে রমজানবেগ সামাজিক কবরস্থানে একসঙ্গে পাশাপাশি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। একসঙ্গে স্ত্রী ও ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ দ্বীন ইসলাম।

লঞ্চ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা নিহত আরিফা বেগমের শ্বশুর আব্দুর রব ব্যাপারী বলেন, ‘দেখলাম আমাদের লঞ্চের পাশ দিয়া একটা জাহাজ আসল। একটা শব্দ হইল, আমাদের লঞ্চটা বইট্টা গেল। পিছে ডাইব্বা গেল। বউ (পুত্রবধূ) কইল- আব্বা কি হইছে? আমি বললাম, লঞ্চতো অ্যাকসিডেন্ট হইয়া গেছে গা। বউয়ের হাতে ধইরা টান দিয়া লঞ্চের গলি দিয়া বের হইতে লইছি- এমন একটা ঢেউ আইলো বাম হাত দিয়া লঞ্চ আর ডাইন হাত দিয়া বউরে টাইন্না আনছি। কিন্তু ঢেউ আইসা বউরে আমার হাত হইতে ছুটাইয়া নিয়া গেছেগা। আমি জাহাজের ভিতরে গেছিগা। পরে একটা ব্যাগ পাইছি, এরপর একটা প্লাষ্টিকের বস্তা পাইছি, বস্তাটা ধইরা বস্তার ওপর অজ্ঞান হইয়া গেছি। আমার আর কিছু মনে নাই।’

নিহত আরিফার স্বামী দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘সকালে নাস্তা খাওয়াইয়া আমার বউ বাড়ি থেকে সুস্থ গেল আর ফিরল লাশ হয়ে। আমার বাপেরে ডাক্তার দেখাইতে গেল। আমার বউরে হাতে ধইরা জাহাজে মাইরা দিল, এতগুলো লোক মারল। এর কি হইবো? আমার বাবা ( ছেলে শাফায়েত) নাই। এতক্ষণে কতগুলো ডাক দিতো আমারে। আমার বাবা কই , আমার বাবায় আমারে ডাক দেয় না।’

নিহত শাফায়াতের দাদি রুসি বেগম বলেন, ‘আমার নাতি বুয়া বুয়া কইয়া জীবন দিতো। আমি নাতিরে ডেলি ২০/৪০ টাকা খাওয়াতাম। আমার নাতিরে কই গেলগা, কই পামু আমার নাতিরে।’

নিহতের আরিফার ননদ ডালিয়া বেগম বলেন, ‘শিপ এসে লঞ্চের উপরে উঠাইয়া দেয়। একে একে তিন বার দুর্ঘটনা ঘটল। সরকারের কাছে একটাই দাবি- হয় শিপ উঠাইয়া দেন, নাইলে লঞ্চ বন্ধ কইরা দেন।

নিহত আরিফার মেয়ে রেখা আক্তার বলেন, ‘এমন কইরা আর কত মানুষের প্রাণ যাইবো। এতো ছোট নদীর মধ্যে এতো বড় বড় শিপ চালাইতে দেওয়া উচিত না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই।

এ ব্যাপারে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসিব সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত মোট আটজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে সাতজনের মরদেহ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে চারজনের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে, দুইজনের বাড়ি পটুয়াখালী, একজনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ ও চাঁদপুরের আরও দুইজন আমার কাছে থাকা তথ্য মতে নিখোঁজ রয়েছেন।

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার নিহত জয়নাল ভূঁইয়ার ছেলে নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমি মাদরাসায় পড়ি। আমার বাবা ছিল সংসারের একমাত্র উপর্জনশীল ব্যক্তি। বাবা সুস্থ গেল। আমার বোনকে ফোন করে বলল- রান্না করে রাখো, দুপুরে এসে বাড়িতে খাবো। কিন্তু বাবা ফিরল লাশ হয়ে। আর কত প্রাণ গেলে এই লঞ্চ দুর্ঘটনা বন্ধ হইবো।

প্রসঙ্গত, রোববার (২০ মার্চ) দুপুরে নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যায় এমভি রূপসী-৯ নামে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় আশরাফ উদ্দিন নামে মুন্সীগঞ্জগামী একটি লঞ্চ ডুবে যায়। চর সৈয়দপুরের আল আমিননগর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। লঞ্চডুবির ঘটনায় রোববার রাতেই ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে নৌ পুলিশ। পরে সোমবার সকালে ও দুপুরে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মোট আটজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে আরও চারজন। 

নিহতরা হলেন- মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার জয়নাল ভূঁইয়া (৫৫), আরিফা আক্তার (৩৫), তার ছেলে সাফায়েত (১৫ মাস), স্মৃতি রানী (২০), পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের সালমা বেগম (৪০) ও তার মেয়ে ফাতেমা (৭) ও সোনাগাঁয়ের হাড়িয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক উম্মে খায়রুন ফাতেমা (৪০)। আরেকজনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। 

ব.ম শামীম/আরএআর