বরিশালে ইউপি সদস্যের অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগের সূত্র ধরে সরকারি কাজের টাকা ভাগাভাগির ফোনালাপ ফাঁস হয়ে গেছে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। ঘটনাটি ঘটেছে উজিরপুর উপজেলার ৩ নম্বর জল্লা ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদারের সাথে মোবাইলে ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের ১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড কথোপকথনের একটি অডিও জেলা প্রশাসনেরও নজরে এসেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে জেলা প্রশাসন। 

কথোপকথনে অতিদরিদ্রের কর্মসৃজন প্রকল্পের (৪০ দিন) কাজ না করিয়ে টাকা তুলে নেওয়ার পরে তা ভাগবাটোয়ারার বিষয়টি স্পষ্ট। একই সাথে চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা প্রশাসনকে ঘুষ দেওয়ার পরও কেন ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে তা জানতে চাওয়া নিয়ে তর্ক হয়েছে। 

উত্তরে চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ইউএনওর পেছনে ঘুষের দেড় লাখ টাকা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে ঘুরলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ইউএনওর চাহিদা দুই লাখ টাকা, সেই টাকাই দিতে হবে।

তবে কীভাবে কথোপকথনটি ফাঁস হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কথোপকথনটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণতি বিশ্বাস জানান, ফাঁস হওয়া কথোপকথনের খবর তিনি শুনেছেন। কিন্তু সেখানে মেম্বার-চেয়ারম্যান কী নিয়ে আলাপ করেছেন তা শুনেননি। অডিও রেকর্ডটি শুনে কোনো বিষয়ে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

কথোপকথনে ইউএনওকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে যা বলা হয়েছে সেই সর্ম্পকে জানতে চাইলে প্রণতি বিশ্বাস বলেন, উজিরপুর উপজেলায় এমন ঘটনা এটাই প্রথম। আমার বিরুদ্ধে পেছনে বসে কেউ কিছু বললে সেটিতো সত্য হয়ে যাবে না।

ইউএনও বলেন, ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শওকত আলী অসৌজন্যমূলক আচরণের লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগের তদন্ত চলছিল। আপনি জেনে অবাক হবেন  স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ‘এক কথায় অমায়িক লোক’। এক প্রতিবন্ধীর সার্টিফিকেট আনতে গিয়েছিলেন দিপালী হালদার। তাকে সার্টিফিকেট দেননি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তখন দিপালী হালদার তাকে মারধর করতে উদ্যত হন। বিষয়টি জেনে আমি পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করি। 

জানা গেছে, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শওকত আলী গত বছরের শেষ দিকে জল্লা ইউনিয়নের সংরক্ষিত (৪,৫,৬) ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন । সেখানে তিনি ওই ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনেন। 

ডা. শওকত আলী বলেন, ঠিক কবে অভিযোগটি দিয়েছিলাম তা বলতে পারবো না। তবে ইউপি সদস্য দিপালী হালদার প্রতিবন্ধী ভাতার সার্টিফিকেট নিয়ে আমার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।

উপজেলা প্রশাসন জানায়, স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সাথে একাত্মতা পোষণ করে আরও কয়েকজন ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদারকে নিয়ে অনাস্থা পত্র দেন ইউএনওর কাছে। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে চাহিদা মাফিক ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানালে চেয়ারম্যানকে বলে দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রদান করান সরকারি কর্মকর্তারা। সেই অভিযোগের তদন্ত শুরু হলে বিষয়টি নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন ইউপি মেম্বার দিপালী হালদার।

১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের ফোনালাপে যা বলেছেন চেয়ারম্যান-মেম্বার

ইউপি সদস্য দিপালী হালদার : মামি আপনি শুধু শুধু মেম্বারদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে যে কমপ্লেইন দিলেন, আর আপনিও সই দিলেন, এটা ভালো হইলো?

চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার : মানে কি, তুমি আমারে দোষো কেন, খালি খালি কমপ্লেইন দিছি মেম্বারদের দিয়া, এডা কেমন কথা?

দিপালী হালদার : এহন শোনেন, আপনে যে টাকা চাইছেন আমার কাছে, আমি দিছি না আপনারে? ৭০ হাজার টাকা দিছি, আগেরবার কর্মসূচির দিছি ৫০ হাজার টাকা। তাইলে আমি কি আপনারে কম দিছি টাকা বলেন? আমি কর্মসূচির টাকা দিছি ৭০ হাজার, আপনি সেটা বলবেন না ইউএনওকে?

চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার : ৭০ হাজার দেও, আর তুমি ৯০ হাজার দেও, সেটা কোনো বিষয় না। তোমার আসবে কত? হিসাব থাকতে হবে কত টাকায় কত আসবে। ৭০ হাজার, আর ৯০ হাজারের কোনো প্রশ্ন না এখানে।

ইউপি সদস্য দিপালী হালদার :  না...আপনি বলছেন তোমার উপজেলা চাইছে ৪০ হাজার, আর...দিছি এতো, এটা বলে বলছেন এক লাখ টাকা। এহন আমি আপনারে ৭০ হাজার টাকা দিছি, আগের বিলে দিছি ৫০ হাজার টাকা।

বেবী রাণী হালদার : কিসের তোমার এক লাখ টাকা? তোমার পারসেনটেস কত আসবে সেটা জানে সচিব, তা তো আমিও জানি না এখনও। আর উপজেলা দিয়া ধরছে তোমার এবং চেয়ারম্যানের দুইডা প্রজেক্টে তাদের বেশি অভিযোগ, আর সব প্রজেক্ট তো দেখে নাই সেদিন। তারা ৩-৪ টা প্রজেক্ট দেখছে, তার মধ্যে এই দুইটা প্রজেক্টে বেশি অভিযোগ তাদের। পিআইও (অয়ন সাহা) লিখে দিছে, চেয়ারম্যানের প্রজেক্টে এক লাখ ১০ হাজার, আর তোমার প্রজেক্টে দিছে ৯০ হাজার। এই দুইটা প্রজেক্ট দিয়া আমরা এইডা...দাবি করি। আর অন্য প্রজেক্ট বাদই দিলাম। এইডা আমরা দাবি করি এই ২ লাখ টাকা। তো অন্যান্য মেম্বাররা, তারা যে... ১০/১৫ হাজার করে দিছে, তারাই তো ভালো। এখন আমি তো...এরপরে সবাই মিলে আমারে ধরছে ৭০ হাজার, তোমারে ধরছে কত, ৫০ না, জানি কত হাজার।

ইউপি সদস্য দিপালী হালদার : আমারে টাকা ধরছে কে, আপনি?

চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালাদার : সবাই মিলে, সব মেম্বাররা...১০-১৫ হাজার টাকা করে, যার যার কাজের মানের ওপর। আমারে একারে ধরছে ৭০ হাজার, আমি সেই ৭০ হাজার টাকা দিয়ে দিছি, একেবারে নগদ দিছি... সচিবের কাছে ৭০ হাজার টাকা জমা। আর উপজেলার টাকার সাথে পারসেনটেসের টাকার কি যোগাযোগ, তুমি আগে পারসেনটেস বাবদ ৫০ হাজার টাকা দিয়া দিছো। আর শেষে তুমি ২০ হাজার টাকা দিছো, এখন তোমার কাছে পারসেনটেসের হিসাবে আরও পায়।

ইউপি সদস্য দিপালী হালদার : আমি একবার ৭০ হাজার, পরে ৫০ হাজার টাকা দিছি, ওই কাজে আমি মোট এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিছি, আর কত দিবো? এজন্যই তো রাগ হয়ে বলছি, আমি আর টাকা দিতে পারবো না।

চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার : আমি চেয়ারম্যান হইয়া ৭০ হাজার টাকা দিতে পারছি, আমার স্বামী (নিহত চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালাদার নান্টু) এতো টাকা ঋণ-দেনা রেখে গেছে, ব্যাংকে...বাড়ি-ঘর সব। আমি সেগুলো দিতে পারছি, আমি চেয়ারম্যান হইয়া। আর তোমরা মেম্বার হইয়া দিতে পারবা না, তোমরা উপজেলায় গিয়া বুঝবা, এইখানে বুঝবা, ওইখানে বুঝবা। বেশ বোঝো, সমস্যা কী?

ইউপি সদস্য দিপালী হালদার : আমাদের কাজ ভালো না হলে তারা (উপজেলা প্রশাসন) বিল দেবে না, কিন্তু ইউএনও, পিআইও আমাদের কাছে এতো টাকা চায় কেন? এগুলো আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন না।

চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার : বলতে পারি না ...আবার, বলছি না। সব ইউনিয়ন থেকেই নিছে, যে যে ইউনিয়নের কাজের মান ভালো না, সবাই দিছে, কম আর বেশি। এখন.. জল্লা ইউনিয়নের কাজ যথেষ্ঠ খারাপ কইছে। জল্লা থেকে দুই লাখ টাকার কম তারা (উপজেলা প্রশাসন) নিবেই না, আমি দেড় লাখ টাকা নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে ঘুরতেছি। তারা (উপজেলা প্রশাসন) কোনো টাকাই ধরে না, দুই লাখ টাকার এক টাকাও কম নিবে না। ইউএনওর থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত টাইম নিছিলাম, যে এর মধ্যে টাকা দিয়ে দিবো। শেষে আমারে ইউএনও পর্যন্ত ধরছে সেই টাকার জন্য। আগে তো...পিআইওর সাথে সচিবের সাথে কথা হতো। আমার সাথে বেশি কিছু বলে নাই। এখন তো ইউএনও সরাসরি সেদিন আমারে ধরছে, যে আপনি সেই টাকা কবে দিবেন? আপনি তারিখ দেন কবে দিবেন। আমি তারিখ দিয়ে আসছি, গত সপ্তাহের মধ্যে। কিন্তু সেই তারিখ তো শেষ, এখন এই সপ্তাহও যায়। তারা (উপজেলা প্রশাসন) এক টাকাও কম নেবে না।

কথোপকথনের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার বলেন, আমি ওই ধরনের কোনো কথা বলিনি। কেউ হয়তো আমার কণ্ঠ নকল করে অডিও ছড়িয়ে দিয়েছে। 

পরক্ষণে এই চেয়ারম্যান বলেন, ইউপি মেম্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে। তা নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। 

ভাগবাটোয়ারার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বেকায়দায় আছি। কোনো কথা বলতে পারছি না।

ইউপি সদস্য দিপালী হালদার স্বীকার করেন কথোপকথনের কণ্ঠ তার। কিন্তু যা বলেছেন সে বিষয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মোবাইলের লাইন কেটে দিয়ে বন্ধ করে দেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অয়ন সাহা বলেন, অনিয়মের অভিযোগে বেশ কয়েকটি কাজের টাকা আমরা আটকে দিয়েছি। 

ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, যা বলছে তা তাদের বিষয়। কেউ বললেই তো তা সত্য হয় না। আর সরকারি কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ টাকা তুললে তাতে আমার কী? 

অয়ন সাহা দাবি করেন, তিনি কোনো ঘুষ গ্রহণ করেননি।

প্রসঙ্গত, উজিরপুর উপজেলার ৩ নম্বর জল্লা ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৪১ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে ওই ইউনিয়নের সবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে কাজ না করে টাকা নিয়ে গেছেন জনপ্রতিনিধিরা।  এই কথোপকথনে ঘুষের সেই টাকার ভাগাভাগির বিষয়টি ফাঁস হয়।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর