ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। প্রিয় ছিলেন সবার। তার আলোয় আলোকিত বহু শিক্ষার্থীর জীবন। এদের অনেকেই এখন চাকরি করেন, কেউ হয়েছেন শিক্ষক। অথচ এখন ভিক্ষা করেন তাদের প্রিয় শিক্ষক।

বলছিলাম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের কথা। আকচা ইউনিয়নের বুড়িরবাঁধ এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত ঘরে থাকছেন তিনি। একসময়ের আলোচিত এই শিক্ষক এখন মানসিক ভারসাম্যহীন। ১৫ বছর ধরে ভিক্ষা করে জীবন চলছে তার।

একসময় যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন আজ সেটি তার আশ্রয়স্থল। নেই সংসার, নেই খাবারের ব্যবস্থা। ভিক্ষা করে যা পান তাই খেয়ে বেঁছে আছেন এই মানুষ গড়ার কারিগর।

স্থানীয় সূত্র জানায়, জয়নুল আবেদিনের জরাজীর্ণ শরীর। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তিনি। খেয়ে না খেয়ে থাকতে থাকতে হাত-পা শুকিয়ে গেছে তার। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কথা বলতে পারেন না। পুরো শরীরে ব্যথা। বার বার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

একসময় যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন আজ সেটি তার আশ্রয়স্থল/ছবি: ঢাকা পোস্ট

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে জয়নুল আবেদিন সদর উপজেলার খড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াতেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে ইংরেজির ভালো শিক্ষক হিসেবে সবার প্রিয় হন জয়নুল আবেদিন।

২০০০ সালে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে রাগারাগি হয় এই শিক্ষকের। এরপর রাগ করে বিদ্যালয় থেকে চলে যান তিনি। পরবর্তীতে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০০১ সালে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দবির উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করেন এই শিক্ষক। কিন্তু অর্থাভাবে মামলা চালাতে পারেননি। এরপর আর কোথাও চাকরি নেননি। এরই মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন জয়নুল আবেদিন। ২০০৫ সাল থেকে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেন তিনি।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন দেরিতে বিদ্যালয়ে আসার কারণে দবির উদ্দিনের সঙ্গে রাগারাগি হয় জয়নুল আবেদিনের। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা একাধিকবার বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করলেও তাদের সঙ্গে বসতে রাজি হননি জয়নুল আবেদিন। এরপর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

জয়নুল আবেদিনের শিক্ষার্থী মো. মুসা ঢাকা পোস্টকে বলেন, একসময় স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম। ইংরেজি অনেক ভালো পড়াতেন। এখন স্যার যেখানে থাকছেন সেখানে আমাদের প্রাইভেট পড়াতেন। হঠাৎ স্যারকে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়। কিছুদিন পরই স্যারের জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। এখন স্যারের অবস্থা দেখে কষ্ট লাগে। আমি সাধ্যমতো স্যারকে সহায়তার চেষ্টা করছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত ঘরে থাকছেন শিক্ষক জয়নুল আবেদিন/ছবি : ঢাকা পোস্ট

স্থানীয় বাসিন্দা, রঘুনাথ, জয়নাল ও কাসেমসহ কয়েকজন জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাঁধের পাশে পরিত্যক্ত ঘরে থাকেন শিক্ষক জয়নুল আবেদিন। প্রায়ই রাস্তার ওপর বসে থাকেন। তিনি সবার পরিচিত শিক্ষক। তার কাছে পড়াশোনা করে অনেকেই মানুষ হয়েছেন। অনেকে বড় চাকরি করেন, কেউ হয়েছেন শিক্ষক। অথচ জয়নুল স্যারকে দেখার কেউ নেই। অসহায় দিন কাটছে তার।

জয়নুল আবেদিন অনেক ভালো শিক্ষক। তিনি আমারও শিক্ষক। তবে তিনি সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে আসতেন না। অনেক রাগী মানুষ। খড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দবির উদ্দিন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন। একাধিক শিক্ষককে তার বাসায় রেখেছেন। যখন খড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তখন জয়নুল স্যার ফাড়াবাড়ির বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পরে তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়।

সাবিরুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষক, খড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়

 সাবিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জয়নুল আবেদিন স্যার সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে আসতেন না। একদিন দেড়টার দিকে বিদ্যালয়ে আসেন। তখন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দবির উদ্দিন দেরি করে আসার কারণ জানতে চাইলে জয়নুল আবেদিন স্যার রেগে যান। একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। পরে জয়নুল আবেদিন চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি মামলা করেন। মামলা চলা অবস্থায় দবির উদ্দিন মারা যান। পরে মামলা খারিজ হয়ে যায়। আমরা অনেকবার জয়নুল স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে বলেছি। কিন্তু তিনি আর শিক্ষকতা করেননি।

প্রধান শিক্ষক সাবিরুল ইসলাম আরও বলেন, এরই মধ্যে অসুস্থ হন জয়নুল আবেদিন। অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে তাকে অনেকবার দেখতে গেছি। তাকে অনেকবার সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যখনই আমি তাকে দেখতে গেছি তখনই তিনি অভিমানে আড়ালে চলে গেছেন। 

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, জয়নুল আবেদিন মাস্টারকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গৃহহীনদের জন্য সরকার যে ঘর দিচ্ছে, ওই শিক্ষকের জন্য একটি সরকারি ঘরের ব্যবস্থা করা হবে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসায় সহায়তা দেওয়া হবে।

এএম