ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দ্বিতীয় দফায় নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। জেলার প্রধান নদী সোমেশ্বরী, কংস, মগড়া ও ধনুর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে কীর্তনখোলা, চরহাইসদা ও গোমাইলসহ বেশ কয়েকটি ফসল রক্ষা বাঁধ।

বিশেষ করে হাওরদ্বীপ হিসেবে পরিচিত জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার প্রধান নদী ধনুর পানি সোমবার (১৮ এপ্রিল) দুপুর ১টা পর্যন্ত বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে ধনু নদী সংলগ্ন সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কীর্তনখোলা ফসল রক্ষা বাঁধ। বাঁধটির বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল ও ধস দেখা দিয়েছে। তবে ফাটল বা ধস দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা মেরামত করে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষকরা। 

তবুও স্থানীয় কৃষকদের দুশ্চিন্তা যেন কিছুতেই কমছে না। কৃষকরা আশঙ্কা করছেন, ধনু নদীর পানির চাপের কারণে যেকোনো সময় কীর্তনখোলা ফসল রক্ষা বাঁধটি ভেঙে হাওরের কয়েক হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে কৃষকরা যেভাবে পারছেন, কাঁচা ও আধা পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন।

খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের কৃষক শফিকুল ইসলাম জানান, আমরা হাওরজুড়ে ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ ও হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করেছিলাম। এর মধ্যে ব্রি-২৮ জাতের ধান কাটা মোটামুটিভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ব্রি-২৯ এবং হাইব্রিড জাতের ধান এখনও ঠিকমতো পাকেনি। আর এক সপ্তাহ সময় পেলে এসব ধান কেটে ঘরে তোলা সম্ভব হবে।

তিনি হতাশার সুরে বলেন, প্রতিদিনই ধনু নদীর পানি বাড়ছে এবং পানির চাপে কীর্তনখোলা বাঁধে একটু পর পর ফাটল ও ধস দেখা দিচ্ছে। আমরা এলাকার কৃষকরা মিলে বাঁধ পাহারা দিচ্ছি এবং ফাটল ও ধস দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা মেরামত করছি। কিন্তু পানি যদি বাড়তে থাকে তাহলে বাঁধটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। যেকোনো মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকে পড়তে পারে। 

নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, কীর্তনখোলা ফসল রক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থানে ফাটল ও ধস দেখা দিলেও স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে ভাঙন প্রতিরোধে দিনরাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও জেলার কোনো বাঁধ এখনও ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি।

কীর্তনখোলা বাঁধ ছাড়াও গোমাইল ও চরহাইসদা ফসল রক্ষা বাঁধসহ বেশ কয়েকটি বাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ অবস্থায় যেকোনো মুহূর্তে এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকে সোনালি ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে কৃষকদের।

নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকতের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, দ্বিতীয় দফায় ধনু নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানির অতিরিক্ত চাপের কারণে কির্তনখোলা বাঁধটি চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। বাঁধের কয়েকটি স্থানে ফাটল ও ধস দেখা দিয়েছে। আমরা স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে সবসময় বাঁধে অবস্থান করে ফাটল ও ধস দেখা মাত্রই মেরামত করছি এবং বাঁধের ভাঙন প্রতিরোধে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, দুদিন ধরে পানি বৃদ্ধির মাত্রা একটু বেশি। সোমবার (১৮ এপ্রিল) দুপুর ১টা পর্যন্ত ধনু নদীর পানি খালিয়াজুরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বাঁধটির ঝুঁকি আরও বাড়বে।

নেত্রকোণা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এফএম মোবারক আলী জানান, এ বছর জেলার ১০ উপজেলায় ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৩ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে এবং জেলার হাওরাঞ্চল মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলায় ৪০ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। বন্যার কবল থেকে বাঁচতে ৮০ ভাগ ধান পাকলেই কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। আমরাও কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দিচ্ছি। এ পর্যন্ত হাওরে ৭০ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। নতুন পুরাতন মিলিয়ে ৩৩২টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন এবং ১০ হাজারের মতো কৃষি শ্রমিক হাওরাঞ্চলের ফসল কাটার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। 

এসব বিষয় নিয়ে নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সরকার হাওরের ফসল রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিয়মিত তদারকি করছেন। পানি আর না বাড়লে কৃষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছি।

তবে এর আগে প্রথম দফায় উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার চুনাই ও মদন উপজেলার তলার হাওরসহ কয়েকটি হাওরের নিচু এলাকার ৫০০ একর জমির বোরো ধান পানিতে যায়। এতে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোণায় ১৩২টি হাওরে ৩৬৫ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে জেলার হাওরদ্বীপ খালিয়াজুরী উপজেলাতেই রয়েছে ১৮১ কিলোমিটার বাঁধ।

জিয়াউর রহমান/এসপি/জেএস