কে ঈদের জামা কিনে দেবেনে, দুই ভাইরে কে ঘাড়ে করে ঘোরাবেনে
রবিউল ও জিহাদ সম্পর্কে আপন দুই ভাই। রবিউল (১০) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়লেও জিহাদ (৫) এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। ঈদ চলে এসেছে। ৫ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন ট্রাকচালক বাবা জালাল হাওলাদার। সন্তানদের কথা দিয়ে গেছেন রোববার ফিরে এসে মার্কেটে নিয়ে যাবেন। দুই সন্তানকে কিনে দেবেন নতুন জামা-কাপড়।
পরিবারের জন্য একটু ভালো পোশাক কেনার আশায় ব্যবহৃত মোবাইলটিও বিক্রি করে দিয়েছেন ৩ হাজার টাকায়। আজ (রোববার) সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের খানিকটা আগেই বাড়িতে ফিরেছেন জালাল। তবে জীবিত নয়, মৃত।
বিজ্ঞাপন
রোববার (১ মে) সকালে বাগেরহাটের ফকিরহাটে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনজন নিহতের মধ্যে একজন বাগেরহাট শহরের খারদ্বার এলাকার রুস্তম হাওলাদারের ছেলে ট্রাকচালক জালাল হাওলাদার (৩৫)।
বিজ্ঞাপন
আজ দুপুরে নিহতের মরদেহ শহরের আলিয়া মাদরাসা সড়ক সংলগ্ন ভাড়া বাড়িতে পৌঁছালে শোকের মাতম শুরু হয় সেখানে। স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে আশেপাশের পরিবেশ। বাচ্চা দুটির মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে দেখা যায় স্থানীয় অনেককেই।
নিহতের বড় ছেলে রবিউল হাওলাদার বলে, আব্বু আমারে আর ভাইরে বলে গেছে ঈদের তা (পোশাক) কিনে দিবে এসে। অনেক খাবার কিনবে আমাদের নিয়ে। ঈদের দিন সেই সব খাব। কিন্তু আব্বু তো এখন কথাই বলে না। আল্লাহর কাছে চলে গেছে। কে দেবেনে ওইসব কিনে। ঘাড়ে করে নিয়ে কে ঘোরাবেনে আমাদের দুই ভাইরে।
নিহতের স্ত্রী পলি বেগম বলেন, ৫ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমারে বলে গেছে ছেলেদের তুমি দেখে রাইখো। ঈদে অনেক খরচ। আমি একবারে টাকা পয়সা জোগাড় করে বাড়ি ফেরবো। গেল রাতেও সেহেরিতে আমারে ফোন দিয়ে ডাইকে দিছে। বলিছে আমি সন্ধ্যার (রোববার) মধ্যে বাড়ি চলে আসবানি।
ছেলেদের জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার জন্য বড় মোবাইলও তিন হাজার টাকায় বেইচে দিছে। কিন্তু এ আমার কি সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন আমি নাবালক দুইটা বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব, ওদের কি খাওয়াব, বাড়ির ভাড়াই বা কীভাবে দেব। আমার তো সব শেষ হয়ে গেল।
নিহতের মা হাসিনা বেগম বলেন, আমার তিন ছেলের মধ্যে জালাল মেঝ। সব সময় যাওয়ার আগে আমারে ডাক দিয়ে বলে যায় মা আমি গেলাম। এবারও যাওয়ার আগে আমার হাতে ত্রিশ টাকা দিয়ে বলে মা কাজের তে আইসে তোমারে বেশি টাকা দেব, এখন টাকা নেই। আমি তো টাকা চাই না, আমি আমার ছেলে চাই। আল্লাহ ঈদের আগে আমাদের এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল। ছোট ছোট দুটো পোতা, ওদের কে দেখবে এখন।
এদিকে জালাল হাওলাদারের মৃত্যুর খবরে রোববার বিকেলে তার বাড়িতে গিয়ে শোকসন্তপ্ত পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নাছির উদ্দিন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মাদ মুছাব্বেরুল ইসলাম, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন, বাগেরহাট প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার আব্দুল বাকীসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, পরিবারটির এ ক্ষতি অপূরণীয়। তারপরও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পরবর্তীত আরও সহযোগিতার আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত বাগেরহাটের ফকিরহাটে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক শিশুসহ তিনজন নিহত এবং অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছে। নিহতরা হলেন টাঙ্গাইল জেলার মাসুদ শেখের শিশু পুত্র আয়াস শেখ, বাগেরহাট শহরের খারদ্বার এলাকার রুস্তম হাওলাদারের ছেলে ট্রাক চালক জালাল হাওলাদার (৩৫) এবং ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা এলাকার শুকুর আলীর ছেলে বাস চালক আব্দুল্লাহ (৪০)।
তানজীম আহমেদ/আরআই